
ইন্দোনেশিয়া তাদের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বিতর্কিত স্বৈরশাসক সুহার্তোকে ‘জাতীয় বীর’ ঘোষণা করেছে। তবে দেশজুড়ে এ সিদ্ধান্ত ঘিরে দেখা দিয়েছে তীব্র সমালোচনা ও প্রতিবাদ।
১৯৬০-এর দশক থেকে ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত ‘নিউ অর্ডার’ শাসনামলে সুহার্তোর নেতৃত্বে ইন্দোনেশিয়া দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন করলেও তার শাসনকাল ছিল ভয়াবহ রাজনৈতিক দমন-পীড়ন ও রক্তক্ষয়ের প্রতীক। ধারণা করা হয়, তার ক্ষমতার সময়ে লাখো রাজনৈতিক বিরোধীকে হত্যা করা হয়েছিল।
প্রতি বছর দেশটির রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যেসব ব্যক্তিকে জাতীয় উন্নয়ন ও অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ‘জাতীয় বীর’ উপাধি দেওয়া হয়, সেই তালিকায় সোমবার (১০ নভেম্বর) নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে ১০ জনের নাম। এর মধ্যে অন্যতম ছিলেন প্রয়াত প্রেসিডেন্ট সুহার্তো। রাজধানী জাকার্তায় রাষ্ট্রপতি প্রাসাদে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বর্তমান প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তো—যিনি সুহার্তোর জামাতা—এই উপাধি প্রদান করেন।
সুহার্তোর সন্তানরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি কার্যালয়ের সরাসরি সম্প্রচারে জানানো হয়, স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ১৯৪৫ সালে জাপানি সেনাদের নিরস্ত্রীকরণে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সুহার্তো, এবং সে সময় থেকেই তিনি জাতির গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন।
তবে এ সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন ও নাগরিক সমাজ। গত সপ্তাহে প্রায় একশ মানুষ জাকার্তায় বিক্ষোভ করেছেন সুহার্তোর মনোনয়নের বিরুদ্ধে। অনলাইনে প্রায় ১৬ হাজার মানুষ এ সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে পিটিশনে সই করেছেন। সোমবার (১০ নভেম্বর) নতুন করে আরেকটি বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়েছে, যার আগেই রাজধানীতে শতাধিক নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন করা হয়েছে।
অ্যামেনেস্টি ইন্দোনেশিয়া এক বিবৃতিতে বলেছে, সুহার্তোকে জাতীয় বীর ঘোষণা ‘তার স্বৈরশাসনের পাপ ধোয়ার প্রয়াস’ এবং ‘ইতিহাস বিকৃত করার প্রচেষ্টা’।
১৯৬৫ সালে ক্ষমতা দখলের সময় অন্তত পাঁচ লাখ সন্দেহভাজন কমিউনিস্টকে হত্যা করা হয়—যা আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ। ক্ষমতায় থাকার তিন দশকে সুহার্তোর শাসন ছিল নিপীড়ন, গুম, নির্যাতন ও গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা দমনের প্রতীক। ১৯৭৫ সালে পূর্ব তিমুরে তার নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযান ছিল শীতল যুদ্ধকালীন সবচেয়ে নৃশংস সামরিক অভিযানের একটি।
তবুও অস্বীকার করা যায় না যে, আধুনিক ইন্দোনেশিয়ার গঠন ও উন্নয়নে সুহার্তোর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তার শাসনামলে দেশটির অর্থনীতি গড়ে প্রতি বছর ৭ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। ১৯৬৬ সালে যেখানে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬০০ শতাংশেরও বেশি, সেটি নেমে আসে প্রায় ১০ শতাংশে। ফলে তিনি ‘বাপাক পেম্বাঙ্গুনান’ বা ‘উন্নয়নের জনক’ হিসেবে পরিচিত হন।
তবে অর্থনৈতিক সাফল্যের আড়ালে ছিল ব্যাপক দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার। ধারণা করা হয়, তিনি ক্ষমতায় থাকার সময় বিলিয়ন ডলার আত্মসাৎ করেছিলেন।
১৯৯৮ সালে এশীয় আর্থিক সংকটের সময় ব্যাপক গণবিক্ষোভের মুখে তিনি পদত্যাগ করেন। এরপর তুলনামূলক শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়। ২০০৮ সালে ৮৬ বছর বয়সে মৃত্যুর পর তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।
দীর্ঘদিন ধরে সুহার্তোর সমর্থকেরা তাকে জাতীয় বীর ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছিলেন, কিন্তু তার বিতর্কিত উত্তরাধিকার নিয়ে আপত্তির কারণে এ উদ্যোগ থমকে ছিল। তবে তার জামাতা প্রাবোও সুবিয়ান্তোর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই ঐতিহাসিক পুনর্মূল্যায়নের আশঙ্কা বাড়ে। প্রাবোও নিজেই নির্বাচনী বক্তৃতায় সুহার্তোর শাসনকে প্রশংসা করেন এবং পরবর্তীতে তার প্রশাসন ইতিহাসের নতুন সংস্করণ প্রকাশের উদ্যোগ নেয়, যা সমালোচকদের মতে, ‘নিউ অর্ডার’ আমলের নৃশংসতা আড়াল করার প্রয়াস।
প্রাবোও নিজেও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত। অভিযোগ আছে, তিনি ১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকে সুহার্তো সরকারের নির্দেশে গণতন্ত্রপন্থি ২৩ জন কর্মীকে অপহরণ ও নির্যাতন করেছিলেন; তাদের মধ্যে ১৩ জন আজও নিখোঁজ।
তবে একই অনুষ্ঠানে সুহার্তোর বিরোধী দুই ব্যক্তিত্বকেও জাতীয় বীর হিসেবে সম্মান জানানো হয়—দেশটির চতুর্থ প্রেসিডেন্ট আবদুর রহমান ওয়াহিদ (গুস দুর) এবং শ্রমিক নেতা মারসিনাহকে।
গুস দুর ছিলেন উদারপন্থি নেতা, যিনি প্রকাশ্যে সুহার্তোর সমালোচনা করেও বাস্তববাদী রাজনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। অন্যদিকে ১৯৯৩ সালে নিহত শ্রমিক নেতা মারসিনাহ ছিলেন শ্রমিক অধিকারের সংগ্রামের প্রতীক এবং সুহার্তো শাসনের সময় দমননীতির শিকারদের অন্যতম।
বিশ্লেষকদের মতে, সুহার্তোর মতো বিতর্কিত এক শাসককে জাতীয় বীরের মর্যাদা দেওয়া ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাস ও মানবাধিকারের প্রতি রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।