দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে কোরবানির ঈদের পর চামড়ার বাজারে চরম ধস নেমেছে। সরকার নির্ধারিত মূল্যে কোনো চামড়াই বিক্রি হচ্ছে না। গরুর চামড়া বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৩০০ থেকে ৭০০ টাকায়, আর ছাগলের চামড়ার দাম নেমে এসেছে ১০ টাকায়—যা স্থানীয়ভাবে এক কাপ চায়ের দামের সমান। এমন পরিস্থিতিতে হতাশ হয়ে অনেকেই ছাগলের চামড়া ফেলে দিচ্ছেন নদীতে।
রবিবার ঈদের দ্বিতীয় দিন সরেজমিন ফুলবাড়ী পৌর শহরের নিমতলা মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, সড়কের পাশে চামড়া বিক্রির ভিড়। আশপাশের গ্রামাঞ্চল থেকে অনেকেই চামড়া নিয়ে এসেছেন। তবে সরকার নির্ধারিত দাম তো দূরের কথা, ন্যূনতম মূল্যও পাচ্ছেন না বিক্রেতারা।
এক বিক্রেতা আহসান হাবিব বলেন, ‘সরকার ঢাকঢোল পিটিয়ে চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে। কিন্তু সেই দাম কেবল কাগজে কলমেই আছে। বাস্তবে কোনো প্রয়োগ নেই। আমি একটি গরু ও একটি ছাগলের চামড়া এনেছিলাম। গরুর চামড়া ৫০০ টাকায় বিক্রি করেছি। কিন্তু ছাগলের চামড়ার কোনো দাম না থাকায় নদীতে ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছি।’
একই অভিযোগ করেন আরেক বিক্রেতা মুজাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘চামড়ার কোনো ক্রেতা নেই। স্থানীয় মাদ্রাসার হুজুরকে ফোন দিয়েছি, তিনিও আসেননি। তাই চামড়ায় লবণ দিয়ে রেখে দিয়েছি। ইউটিউব দেখে চেষ্টা করব বাড়িতে বসেই কিছু তৈরি করতে পারি কিনা।’
প্রসঙ্গত, সরকার ২০২৫ সালে ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর প্রতি বর্গফুট চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করেছে ৬০-৬৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৫৫-৬০ টাকা। ছাগলের চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ২০-২২ টাকা প্রতি বর্গফুট, আর খাসির জন্য ২২-২৭ টাকা। যদিও এই মূল্যতালিকা কোরবানি দাতাদের কিছুটা আশার আলো দেখালেও, বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
ফুলবাড়ীর স্থানীয় বাজারে কোনো ক্রেতাই ওই দামে চামড়া কিনছেন না। গরুর একটি চামড়া ৩০০ থেকে ৭০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে, যা সরকার নির্ধারিত মূল্যের অনেক নিচে। আর ছাগলের চামড়া বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১০ টাকায়—তাও সবাই কিনতেও আগ্রহী নন।
স্থানীয় চামড়া ব্যবসায়ী কোরবান আলী বলেন, ‘আমরা চামড়া কিনছি কম দামে, কারণ ট্যানারিরা সরকার নির্ধারিত দামে কিনছে না। তারাও বলছে, অতিরিক্ত চামড়া তাদের প্রয়োজন নেই, সংরক্ষণের সুবিধাও নেই। আমরা আকারভেদে গরুর চামড়া ৩০০ থেকে ৭০০ টাকায় এবং ছাগলের চামড়া মাত্র ১০ টাকায় নিচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘লবণের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত বছর প্রতি মণ লবণ ছিল ৪৭০ টাকা। এবার তা বেড়ে ৬৫০ টাকায় পৌঁছেছে।’
গত বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতায় তিনি বলেন, ‘গত বছর সরকারী দামে চামড়া কিনে অনেক লোকসান করেছি। অনেক চামড়া সংরক্ষণ করতে না পেরে ফেলে দিতে হয়েছে। তাই এবার সাবধানে মাত্র ২০০টি গরুর চামড়া কিনেছি।’
স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মতে, সরকারকে চামড়ার বাজার ব্যবস্থাপনায় আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কার্যকরভাবে মূল্য নির্ধারণ বাস্তবায়ন, সংরক্ষণের ব্যবস্থা, লজিস্টিক সাপোর্ট এবং মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলোর মাধ্যমে চামড়া সংগ্রহে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার।
চামড়ার বাজারে এমন ধস কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণই নয়, ধর্মীয় দিক থেকেও অনেক মুসলমানের জন্য হতাশার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা চেয়েছিলেন কোরবানির চামড়া দান করে সওয়াব হাসিল করতে, কিন্তু মূল্য না পেয়ে কেউ ফেলে দিচ্ছেন, কেউবা অসহায়ের মতো অপেক্ষায় বসে আছেন। এ অবস্থায় সরকারের দ্রুত হস্তক্ষেপ ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান এখন সময়ের দাবি।