ডিজেল-পেট্রলের বর্ধিত দাম রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধির পর গতকাল শনিবার রাতে বাসের ভাড়া বাড়ায় সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। আজ রবিবার থেকে নতুন ভাড়া কার্যকর হবে। এর আগে গতকাল সকালে ভাড়া বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে বিআরটিএকে চিঠি দেয় সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। তাদের আবেদনে শনিবার বিকাল সোয়া ৫টায় শুরু হয় ভাড়া পুনর্নির্ধারণ কমিটির বৈঠক। সোয়া চার ঘণ্টার বৈঠক শেষে রাতে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বর্ধিত ভাড়ার ঘোষণা করেন। তিনি জানান, নগর পরিবহনের ১৬ দশমিক ২৮ শতাংশ এবং দূরপাল্লার বাসের ভাড়া ২২ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।
সরকারের নতুন হার অনুযায়ী, নগর পরিবহনের ভাড়া কিলোমিটারে ৩৫ পয়সা বেড়েছে। অর্থাৎ, ২ টাকা ১৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে আড়াই টাকা করা হয়েছে। দূরপাল্লার ৫২ আসনের বাসে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া বেড়েছে ৪০ পয়সা। এক টাকা ৮০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে কিলোমিটারে ২ টাকা ২০ পয়সা। তবে দূরপাল্লায় ৫২ আসনের বাস বাস্তবে না থাকায় ৪০ আসনের বাসে প্রকৃত ভাড়া হবে কিলোমিটারে দুই টাকা ৮৬ পয়সা।
ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) আওতাধীন এলাকা অর্থাৎ রাজধানীর পার্শ্ববর্তী পাঁচ জেলার বাসের ভাড়াও কিলোমিটার ৩৫ পয়সা বেড়েছে। ২ টাকা ৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা ৪০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। মহানগরের বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা। মিনিবাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ৮ টাকা।
সড়ক পরিবহন সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী বৈঠকে বলেন, তালিকা অনুযায়ী ভাড়া নিতে হবে। জ্বালানি বিভাগ তেলের বর্ধিত দামের সঙ্গে সমন্বয় করে দূরপাল্লার বাসে ২৯ এবং নগর পরিবহনে ২৮ পয়সা ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছিল। তবে মালিকদের দাবি ছিল ৫০ পয়সার বেশি বাড়ানো। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেছেন, যাত্রীদের স্বার্থে সরকার যে ভাড়া নির্ধারণ করেছে তা মালিকরা মেনে নিয়েছেন। সিএনজিচালিত বাসের ক্ষেত্রে নতুন ভাড়া প্রযোজ্য হবে না।
এদিকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় লঞ্চের ভাড়া বাড়ানোরও প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শিগগিরই বৈঠক করে নতুন ভাড়া নির্ধারণ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। ভাড়া সমন্বয়ে মালিকরা নিজেদের মধ্যে বৈঠকও করেছেন বলে জানান লঞ্চ মালিক সমিতির নেতারা। তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় জরুরি ভিত্তিতে বৈঠকে বসা হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল যাত্রী পরিবহন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল যাত্রী পরিবহন সংস্থার সিনিয়র সহসভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, ‘আমরা দ্রুতই বৈঠকে বসতে চাচ্ছি। আমাদের একটা সিদ্ধান্তে আসা প্রয়োজন। আমরা আলোচিত এজেন্ডা নিয়ে সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শিগগিরই বৈঠকে বসব।’
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে এর আগে ৭ নভেম্বর বাসের ভাড়া ২৭ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়েছিল সরকার। আট মাস পর আবারও বাড়ল বাসের ভাড়া । এবারও যাত্রী জিম্মি করে বাড়তি ভাড়া আদায় করে নিলেন পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতারা।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির প্রস্তাবে টায়ার, মবিল, ফিল্টারসহ ছয় ধরনের যন্ত্রাংশের দাম বৃদ্ধির হার উল্লেখ করে বলা হয়, এসব যন্ত্রাংশের জন্য ২৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ ও ডিজেলের দাম বাড়ায় ৪২ দশমিক ৫০ শতাংশ সব মিলিয়ে বাস পরিচালনায় ৭০ শতাংশ খরচ বেড়েছে। ওই বৃদ্ধির হারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব করেন খন্দকার এনায়েত উল্যাহ।
বৈঠকে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী, খন্দকার এনায়েত উল্যাহসহ পরিবহন নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সাপ্তাহিক বন্ধের মধ্যে শুক্রবার রাতে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ বাড়িয়ে দেয় সরকার। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ৮০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১৪ টাকা করা হয়। পেট্রলের দাম ৮৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৩০ টাকা এবং অকটেনের দাম ৮৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা হয়েছে। অর্থাৎ নতুন ঘোষণা অনুযায়ী, ডিজেল ও কেরোসিনের দাম প্রতি লিটারে বেড়েছে একলাফে ৩৪ টাকা। অকটেনের দাম ৪৪ টাকা ও পেট্রলের দাম ৪৬ টাকা বাড়ানো হয়।
ভাড়া বাড়ানোর বৈঠকের পর সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, বৈশ্বিক কারণে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। পৃথিবীর যে কোনো দেশের চেয়ে আমাদের দেশে জ্বালানি তেলের দাম কম।’ সচিব দাবি করেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পরও সারাদেশে পরিবহন ব্যবস্থা সচল ছিল। ধর্মঘটে না যাওয়ার জন্য তিনি পরিবহন মালিকদের ধন্যবাদ জানান।
বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার নতুন ভাড়া ঘোষণা করে বলেন, আমরা কয়েক ঘণ্টা ভাড়া পুনর্নির্ধারণ কমিটির সদস্যদের নিয়ে আলোচনা করে তেলের দাম ও যাবতীয় খরচ সমন্বয় করে ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করেছি। মন্ত্রীর অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গতবার ভাড়া নির্ধারণের পর মালিক, শ্রমিক ফেডারেশন, পুলিশ ও বিআরটিএ বাড়তি ভাড়া নেওয়ার বিরুদ্ধে কয়েক মাস অভিযান চালায়। এবারও বাড়তি ভাড়ার বিরুদ্ধে অভিযান চলবে।
এর আগে বাস মালিক ও শ্রমিকদের দাবির মুখে গত ৭ নভেম্বর দূরপাল্লার বাসের ভাড়া ২৭ শতাংশ এবং ঢাকায় ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়িয়েছিল সরকার। তখন দূরপাল্লার বাস ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৪২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১ টাকা ৮০ পয়সা করা হয়। অর্থাৎ কিলোমিটারপ্রতি যাত্রীর ৩৮ পয়সা ভাড়া বাড়ে। এ ছাড়া বড় বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা ও মিনিবাসে ৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগর এলাকায় চলাচলরত বাসের ভাড়া কিলোমিটারে ১ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা ১৫ পয়সা করা হয়। প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া বাড়ানো হয় ৪৫ পয়সা। আর মিনিবাসের ভাড়া ১ টাকা ৬০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা ৫ পয়সা করা হয়। সেখানেও কিলোমিটারপ্রতি ৪৫ পয়সা হারে বাড়ানো হয়।