হাওর রক্ষা আন্দোলনে কানাডা প্রবাসী মৌলভীবাজারবাসীর আহ্বান

ডেস্ক রিপোর্ট
  ১০ জুলাই ২০২৫, ১৩:১৬

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অনন্য প্রাকৃতিক রত্ন হাওর অঞ্চল। বিশেষ করে মৌলভীবাজার জেলার হাকালুকি, হাইল এবং কাউয়াদীঘি হাওর—শুধু নয়নাভিরাম জলরাশি নয়, এগুলো হাজার হাজার মানুষ ও জীববৈচিত্র্যের জীবনরেখা। জলবায়ু, কৃষি, মৎস্য, পাখি, উদ্ভিদ এবং সামগ্রিক জীববৈচিত্র্য এই হাওরভিত্তিক ইকোসিস্টেমের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এই হাওর অঞ্চল আজ বিভিন্ন অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প, দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মারাত্মক হুমকির মুখে।
এই প্রেক্ষাপটে টরন্টোতে অবস্থানরত মৌলভীবাজার জেলার প্রবাসী নাগরিকরা এখন সরব। মৌলভীবাজার জেলা এসোসিয়েশন, টরন্টো- এর পক্ষ থেকে সম্প্রতি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টার কাছে একটি উন্মুক্ত চিঠি পাঠানো হয়েছে, যাতে হাওর অঞ্চলের রক্ষা ও টেকসই উন্নয়নের বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এই চিঠিতে যেসব উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে, তা কেবল আবেগের বিষয় নয়, বরং তথ্যনির্ভর ও যুক্তিসম্মত। হাওরের স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ পরিবর্তনের জন্য যেমন বাঁধ, রাস্তা বা ড্রেজিংয়ের মতো প্রকল্পগুলো দায়ী, তেমনি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে বেড়ে চলেছে অকাল বন্যা ও দীর্ঘমেয়াদি জলাবদ্ধতা। একই সঙ্গে নজিরবিহীনভাবে কমে যাচ্ছে মাছ, পাখি ও অন্যান্য জীবের উপস্থিতি। স্থানীয় কৃষকদের জন্য ধান ফলানো হয়ে পড়েছে অনির্ভরযোগ্য।
এসোসিয়েশনের সভাপতি লায়েকুল হক চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক মুর্শেদ আহমদ মুক্তা চিঠিতে পাঁচটি প্রধান দাবি তুলে ধরেছেন। তারা বলেছেন, হাওরে যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের পূর্বে বাধ্যতামূলকভাবে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন সম্পন্ন করা উচিত। এটি একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নীতি—যার অনুপস্থিতিতেই আজ বাংলাদেশের বহু প্রকল্প দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশগত বিপর্যয় ডেকে আনছে।
তাঁরা আরও বলেছেন, স্থানীয় মানুষ, গবেষক এবং পরিবেশবিদদের পরামর্শ নিয়ে হাওর এলাকায় পরিকল্পনা হতে হবে। হাওরের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। অপরিকল্পিত বাঁধ, সোলার প্ল্যান্ট, শিল্পকারখানা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকতে হবে। উন্নয়নের নামে যেন প্রকৃতির মৃত্যু না ঘটে।
একই সঙ্গে জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য আইনগত সুরক্ষা এবং বাস্তবমুখী সংরক্ষণ উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। বর্তমানে অনেক হাওরে পাখির অভয়াশ্রমের সাইনবোর্ড টাঙানো থাকলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। শুধু আইন করলেই হবে না, মাঠ পর্যায়ে তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
চিঠিতে আরও দাবি করা হয়েছে, হাওরবাসীর সার্বিক জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও দুর্যোগ মোকাবিলায় সময়োপযোগী পরিকল্পনা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। চিঠিটির অনুলিপি পাঠানো হয়েছে মৌলভীবাজার জেলার জেলা প্রশাসক এবং হাওর রক্ষা আন্দোলনের জেলা সদস্য সচিব খসরু মিয়া চৌধুরী-কেও।
 বাংলাদেশে হাওরের গুরুত্ব নতুন কিছু নয়। হাকালুকি হাওরকে ১৯৯৯ সালেই ‘ইকোলজিক্যাল ক্রিটিকাল এরিয়া’ ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সেই ঘোষণার বাস্তবায়ন কোথাও দেখা যায় না। বরং বর্ষায় হাওরে পানি জমে থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে ফসল রক্ষা বাঁধ, রাস্তা নির্মাণ আর বালি ও কাদামাটি জমে জলাশয়গুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
টরেন্টো প্রবাসীরা বলেছেন, " আমরা জানি, উন্নয়ন প্রয়োজন। তবে সেই উন্নয়ন হতে হবে প্রকৃতি ও সমাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। এখন সময় এসেছে উন্নয়ন ও পরিবেশ রক্ষার মধ্যকার ভারসাম্য খোঁজার। প্রবাসীরা এখন কেবল বৈদেশিক মুদ্রা পাঠায় না, তারা নিজের শেকড় নিয়েও ভাবে।"

একাধিক প্রবাসী এ নিয়ে তাদের প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, " এই মুহূর্তে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে হাওর অঞ্চলকে জাতীয় সম্পদ হিসেবে বিবেচনায় এনে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করা। প্রয়োজন হলে হাওর সংরক্ষণ আইন হালনাগাদ করা এবং স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে বাস্তবভিত্তিক কাঠামো তৈরি করা।"  প্রবাসীরা বলেছেন, আমাদের সকলের কণ্ঠেই একটাই প্রত্যয়— হাওর বাঁচাও, বাংলাদেশ বাঁচাও।