বিশ্বের অন্যতম শান্তিপূর্ণ, মানবিক এবং বহুজাতিক রাষ্ট্র কানাডা। বিশাল আয়তনের এই দেশ শুধু তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়, রাষ্ট্রীয় ন্যায়বোধ, উদার মূল্যবোধ ও সুযোগ-সুবিধার জন্য অভিবাসীদের স্বপ্নের ঠিকানা। বাংলাদেশ থেকেও হাজার হাজার মানুষ এই দেশটিতে পাড়ি জমিয়েছেন, কেউ এসেছেন শিক্ষার টানে, কেউ আশ্রয়ের খোঁজে, কেউ উন্নত জীবনের প্রত্যাশায়। আর আজকের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে বলাই যায়, কানাডায় বাংলাদেশিরা কেবল টিকে থাকেননি—নিজেদের সক্ষমতা, সম্মান ও সংস্কৃতির এক দৃঢ় অবস্থান গড়ে তুলেছেন।
টরেন্টোর প্রাণকেন্দ্র ডেনফর্থ এলাকায় হাঁটতে হাঁটতে দেখা হয়ে গেল নেওয়াজ চৌধুরী সাজুর সঙ্গে—আশির দশকে যিনি এসেছিলেন কানাডায়, তখন সবকিছুই ছিল অপরিচিত, নতুন, কঠিন। আবার, সেখানেই দেখা হলো আলী হোসেনের সঙ্গে—সাম্প্রতিক সময়ে কানাডায় এসেছেন, গ্রামীণ বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে। এই দুই প্রজন্মের অভিবাসীর চোখেমুখে আমি একই জিনিস দেখেছি—স্বদেশের মমতা, স্বদেশিদের প্রতি অদ্ভুত এক ভ্রাতৃত্ববোধ। কানাডা প্রবাসী একজন মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী সত্তরোর্ধ অভিজ্ঞতা নিয়ে আজও বাংলাদেশি কমিউনিটির পাশে দাঁড়ান, আরেকজন স্বপ্নের কানাডায় নিজের নতুন যাত্রার কথা বলেন। এইসব মুখই যেন বাংলাদেশের দুটো ভিন্ন সময়ের প্রতিনিধি, কিন্তু কানাডায় এসে দাঁড়িয়েছে একই পথচলার মোহনায়।
চারদিন কানাডার বিভিন্ন শহর ঘুরে যত বাংলাদেশিকে দেখেছি, কথা বলেছি—প্রত্যেকের জীবনে মিশে আছে আনন্দ, সংগ্রাম, উচ্ছ্বাস, আর এক গভীর বেদনার কাব্য। কারও মনে পুরোনো দেশের নস্টালজিয়া, কারও চোখে নতুন দেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে কানাডায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মানুষের সংখ্যা ২ লক্ষাধিক। এর মধ্যে অনেকেই স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে নিজেদের কানাডায় শেকড় গেড়েছেন। কেউ কেউ ব্যবসা করছেন, কেউ তথ্যপ্রযুক্তি খাতে আছেন, কেউ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াচ্ছেন, কেউ বা সরকারি সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন।
বিশেষ করে টরেন্টো, মন্ট্রিয়াল, ভ্যাঙ্কুভার ও অটোয়ার মতো শহরগুলোতে গড়ে উঠেছে সুসংগঠিত বাংলাদেশি কমিউনিটি। ডেনফর্থে রয়েছে বাংলা দোকান, রেস্টুরেন্ট, মসজিদ, মন্দির, বাংলা স্কুল, সাংস্কৃতিক সংগঠন—যেখানে শিশুদের শেখানো হচ্ছে বাংলা বর্ণমালা, গান, ইতিহাস, পরিচয়। কানাডার বাংলাদেশি এলাকাগুলোতে কোরবানির ঈদে রাস্তায় কোলাকুলি হয়, পূজার সময় মন্দির থেকে ভেসে আসে উলুধ্বনি ও শঙ্খধ্বনি, তেমনি একুশে ফেব্রুয়ারিতে কানাডিয়ান শিশুরাও কাগজে আঁকে শহীদ মিনার।
এই কমিউনিটির সবচেয়ে বড় শক্তি হলো আন্তরিকতা। প্রবাসজীবনে একে অন্যের পাশে দাঁড়ানোর যে প্রবণতা, সেটাই আমাদের অন্যতম পরিচয়।
তবে কানাডার জীবন যে নিখুঁত, এমন বলা যাবে না। রয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জ। নতুন অভিবাসীদের জন্য চাকরি পাওয়া কঠিন, বিশেষ করে পূর্বের অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত পেশায় প্রবেশ করতে সময় লাগে। আবাসন ব্যয় বেড়েছে চরমভাবে, ভাড়া মেটাতে গিয়ে অনেকেই পারিবারিক সাশ্রয় হারাচ্ছেন। স্বাস্থ্যসেবার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা, শীতকালীন বিষণ্নতা এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা অনেকের মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলছে।
কানাডার বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশেও কিছুটা পরিবর্তন আসছে। জনসংখ্যা বাড়ছে, বাসস্থান ও পরিকাঠামোর চাপ বাড়ছে। অভিবাসী নীতিতে কিছুটা সংযম দেখা যাচ্ছে, তবে এখনো কানাডা তুলনামূলকভাবে বিশ্বের অন্যতম অভিবাসীবান্ধব রাষ্ট্র।
এই প্রেক্ষাপটেও বাংলাদেশিরা নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সম্মান অর্জন করছেন। কেউ কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন, কেউ নির্বাচনে এমপি প্রার্থী হয়েছেন। অনেকে মূলধারার মিডিয়া, ব্যবসা বা একাডেমিয়ায় জায়গা করে নিচ্ছেন। নতুন প্রজন্ম স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে নিজেকে কানাডিয়ান সমাজে আত্মস্থ করছে—তবে বাংলা গান, নাটক, কবিতা আর উৎসব তাদের মনে ধরে রাখছে বাংলাদেশের ছায়া।
সব মিলিয়ে বলা যায়—বাংলাদেশিরা কানাডায় মোটের ওপর ভালো আছেন। শিকড় বাংলাদেশের মাটিতে হলেও, ডালপালা এখন কানাডার আকাশ ছুঁয়েছে। এই গাছের পাতায় রয়েছে দুই দেশের গল্প—একটি স্মৃতির, আরেকটি সম্ভাবনার।
আমরা যারা দূরদেশে আছি, আমাদের দায়িত্ব হলো—এই অর্জনের গল্পগুলো তুলে ধরা, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানে কীভাবে বাংলাদেশের সন্তানরা প্রবাসে থেকেও নিজের সংস্কৃতি, শ্রম আর সত্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে সম্মানের উচ্চতায়।
কানাডায় বাংলাদেশিরা এখন আর অতিথি নন—তারা হয়ে উঠেছেন এই দেশের সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির অনিবার্য অংশ। যে শক্তি তাদের এখানে টেনে এনেছে, তা কেবল বেঁচে থাকার নয়—বরং সম্মানের সঙ্গে টিকে থাকার, স্বপ্ন দেখার আর ভবিষ্যৎ গড়ার।