রয়টার্স, এএফপি ও দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার প্রকাশ 

নির্বাচন করতে না দিলে আ.লীগের সমর্থকরা ভোট বয়কট করবে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
  ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৩৮
শেখ হাসিনা। ফাইল ছবি: রয়টার্স

জুলাই আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে নির্বাসনে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না পারা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের লাখ লাখ সমর্থক আগামী জাতীয় নির্বাচন বয়কট করবে। বুধবার (২৯ অক্টোবর) ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেছেন। শেখ হাসিনা বলেছেন, তার দলকে বাদ দিয়ে আয়োজিত নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে সরকার গঠিত হলে তিনি দেশে ফিরবেন না, ভারতেই থাকবেন।
শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া আন্দোলন সহিংস হয়ে পড়লে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। ভারতে নির্বাসনের পর এই প্রথমবারের মতো কোনও সংবাদমাধ্যমে তার সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হলো। ভারতের দিল্লি থেকে ই-মেইলে দেওয়া তার সাক্ষাৎকার রয়টার্সের পাশাপাশি ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি ও ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রকাশ করেছে।
রয়টার্সকে শেখ হাসিনা বলেছেন, পরবর্তী সরকারের অবশ্যই নির্বাচনি বৈধতা থাকতে হবে। এজন্য, আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা কেবল নীতিবিরুদ্ধই নয়, আত্মবিধ্বংসীও বটে। কারণ, আওয়ামী লীগের লাখো সমর্থক রয়েছে এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা ভোট দেবেন না। এত মানুষকে বঞ্চিত করে আপনি কার্যকর রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবেন না।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগকে ছাড়া নির্বাচন করে সরকার গঠন করা হলে দেশে ফেরত আসা থেকে বিরতই থাকবেন।
শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসন অবসান হওয়ার পর বাংলাদেশের হাল ধরেছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি নাগাদ দেশে সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের অঙ্গীকার করেছে সরকার।
গত মে মাসে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করেছে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন। এর আগে, দলটির জ্যেষ্ঠ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ এবং জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম স্থগিত করেছিল ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার।
বাংলাদেশে ১২ কোটি ৬০ লাখের বেশি নিবন্ধিত ভোটার রয়েছে। আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল এবং বিভিন্ন অভিযোগের কারণে নির্বাচন স্বচ্ছ হলে বর্তমানে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ভূমিধস জয় পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 
শেখ হাসিনা বলেছেন, আমরা আওয়ামী লীগের ভোটারদের অন্য দলকে সমর্থন দিতে বলছি না। আমাদের আশা, (কর্তৃপক্ষের) শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবো।
আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের কোনও পক্ষের সঙ্গে গোপন আলোচনা চলছে কিনা, সে বিষয়ে তিনি কোনও মন্তব্য করেননি।
এদিকে, রয়টার্সের প্রশ্নের জবাবে অন্তর্বর্তী সরকারের তরফ থেকে কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক উন্নতির জন্য প্রশংসিত হলেও আন্তর্জাতিক মহলে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ভিন্নমত দমনের অভিযোগ ছিল শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে ২০২৪ সালে তিনি টানা চতুর্থবারের মতো নির্বাচনে জয়লাভ করেন। দেশের প্রধান বিরোধীদল ওই নির্বাচন বয়কট করে এবং নির্বাচন সংক্রান্ত বিভিন্ন অভিযোগের কারণে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আরও ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়।
গত বছর, সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে শুরু হওয়া শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সহিংস রূপ নিলে ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। ওই আন্দোলন দমনের সময় সংঘটিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শুনানি চলছে। আগামী ১৩ নভেম্বর একটি রায় আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই-আগস্ট মাসে অন্তত এক হাজার ৪০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া, শেখ হাসিনার শাসনামলে ব্যাপক গুম এবং পুলিশি নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন প্রসিকিউটররা।
তবে, সব অভিযোগ অস্বীকার করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছেন, আন্দোলনে মারণাস্ত্র ব্যবহার বা অন্য অভিযোগের সঙ্গে তার কোনও সংশ্লিষ্টতা নেই। ওগুলো সব রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রহসন। আমাকে আত্মসমর্থনের যথাযথ সুযোগও দেওয়া হয়নি। বরং আদালতের সাজানো শুনানিতে আগেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
তবে, এমন রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থাতেও শেখ হাসিনা আশা প্রকাশ করেন, আওয়ামী লীগ আবার বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, সেটা ক্ষমতাসীন বা বিরোধী যে দলে থেকেই হতে পারে। তবে দলের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে হয়তো তার পরিবারের সংশ্লিষ্টতা নাও থাকতে পারে।
তিনি বলেছেন, এটা তো কেবল আমি বা আমার পরিবারের ইস্যু না। বাংলাদেশের জন্য আমরা সবাই যে ভবিষ্যৎ কামনা করি, তা নিশ্চিত করতে সংবিধানের শাসন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা জরুরি। কোনও একক ব্যক্তি বা পরিবার আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে না।
অবশ্য, শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় গত বছর রয়টার্সকে একবার বলেছিলেন, দল চাইলে তিনি নেতৃত্ব দেওয়ার কথা বিবেচনা করবেন।
দিল্লিতে অবস্থান সম্পর্কে তিনি বলেন, সেখানে তিনি স্বাধীনভাবেই আছেন। তবে তার পরিবারের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ সহিংসতার কারণে সবসময় চোখ-কান খোলা রাখেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সামরিক বাহিনীর কয়েকজন সদস্য তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এবং শেখ হাসিনার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। বিদেশে থাকার কারণে কেবল শেখ হাসিনা এবং তার বোন শেখ রেহানা বেঁচে যান।
কয়েক মাস আগে দিল্লির ঐতিহাসিক লোধি বাগানে শেখ হাসিনাকে দেখার কথা জানিয়েছেন রয়টার্সের এক প্রতিনিধি। কয়েকজন পথচারী তাকে চিনতে পারলে শেখ হাসিনাকে মৃদু হাসিমুখে তাদের দিকে মাথা নাড়তে দেখা যায়। সে সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পাশে দুজন ব্যক্তি ছিলেন, যারা তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় নিয়োজিত বলে ধারণা করা হয়।
দেশে ফেরার বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেছেন, যদি বৈধ সরকার থাকে, সংবিধানের প্রাধান্য রক্ষিত হয় এবং সত্যিকার অর্থে দেশে আইনশৃঙ্খলা বজায় থাকে, আমি অবশ্যই দেশে ফিরতে চাইবো।

শেখ হাসিনা চলে যাওয়ার পর দেশজুড়ে আওয়ামী কর্মীদের ওপর নির্বিচারে ব্যাপক ধরপাকড়ের অভিযোগ উঠেছে। অবশ্য, বর্তমানে দেশের আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক আছে বলে দাবি করছে অন্তর্বর্তী সরকার।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন