যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের খড়্গ

গভীর সংকটে পড়তে পারে বাংলাদেশের পোশাক খাত

ডেস্ক রিপোর্ট
  ১৩ জুলাই ২০২৫, ১৪:৪৭

বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রফতানি খাত তৈরি পোশাক শিল্প এখন গভীর অনিশ্চয়তার মুখে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণায় আগামী ১ আগস্ট থেকে বাংলাদেশি পোশাকে ৩৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে রফতানি, কর্মসংস্থান ও সামগ্রিক অর্থনীতি ভয়াবহ সঙ্কটে পড়বে— এমনই আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষক, উদ্যোক্তা ও নীতিনির্ধারকরা।
নতুন শুল্ক, পুরনো ভীতি: পণ্য হারাচ্ছে বাজার, অর্ডার হারাচ্ছে কারখানা
যুক্তরাষ্ট্রে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৮৭০ কোটি ডলার, যার ৮৫ শতাংশই ছিল তৈরি পোশাক। এ বাজার বাংলাদেশের একক বৃহত্তম রফতানি গন্তব্য। অথচ নতুন এই শুল্ক হার কার্যকর হলে মোট শুল্কহার বেড়ে দাঁড়াবে কমপক্ষে ৫১ শতাংশ, কিছু ক্ষেত্রে তা পৌঁছাবে ৬১ শতাংশে; যা বিশ্বের অন্যতম প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থানকে বড় হুমকির মুখে ফেলে দেবে।
বিশ্বখ্যাত রিটেইল ব্র্যান্ড ওয়ালমার্ট, লিভাইস, এইচঅ্যান্ডএম, জারার মতো গ্রাহকরা ইতোমধ্যে অর্ডার স্থগিত করছে বা পেছাচ্ছে। কেউ কেউ একতরফাভাবে দর কমাতে চাপ দিচ্ছে।
প্যাট্রিয়ট ইকো অ্যাপারেল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইকবাল হোসেন জানান, ওয়ালমার্টের জন্য ১০ লাখ পিস সাঁতারের পোশাকের অর্ডার স্থগিত করা হয়েছে।
অন্যদিকে ক্ল্যাসিক ফ্যাশওনর ফারুক সৈকত এক ই-মেইলে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে শুল্ক আরোপের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বসন্ত মৌসুমের সব অর্ডার স্থগিত করছি।
প্যাসিফিক সোয়েটার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাশেদ বলেন, আমাদের কারখানায় ৬০ হাজার টি-শার্টের কাজ চলছিল। অর্ডারদাতা প্রতিষ্ঠান হঠাৎ ই-মেইলে কাজ স্থগিত করতে বলে। এতে মাঝপথে উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছি; যা বিশাল আর্থিক ক্ষতির কারণ।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতির ভাষ্য, পাইপলাইনে থাকা পণ্যের মূল্য আনুমানিক ২০০ কোটি ডলার। এসব অর্ডার এখন ঝুলে আছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অপেক্ষায়।
অর্থনীতির হৃদস্পন্দন যেখানে পোশাক
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত শুধু রফতানির চালিকাশক্তিই নয়, প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের জীবিকা ও জিডিপির ১০ শতাংশের উৎস। যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড কমিশনের তথ্য বলছে, ২০২৫ সালের প্রথম পাঁচ মাসেই বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানি হয়েছে ৩ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার; যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২১ শতাংশ বেশি।
এই প্রবৃদ্ধি হঠাৎ থমকে গেলে তার অভিঘাত শুধু পোশাক খাতেই নয়, ব্যাংকিং খাত, ভোক্তা চাহিদা, রেমিট্যান্স, আমদানি সক্ষমতা, এমনকি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও পড়বে।
ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, বড় কোম্পানিগুলো কিছুটা মানিয়ে নিতে পারলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
অসম প্রতিযোগিতা: বিপদ আরও গভীর
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বাড়তি শুল্কের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, বৈষম্যমূলক প্রয়োগ। এ শুল্ক আরোপের তালিকায় নেই বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী চীন, ভারত, ভিয়েতনাম ও পাকিস্তান।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা এখন এক ডলার পর্যন্ত দর কমাতে চাপ দিচ্ছে। এটা এক ধরনের অনৈতিক কৌশল। যেন পুরোনো একচেটিয়া অভ্যাসের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
কূটনীতি বনাম শুল্কনীতি
বাংলাদেশ সরকার এখন কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় ব্যস্ত। ৯ জুলাই থেকে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় দফার আলোচনা শেষে সরকারি সূত্র জানায়, ৮০ শতাংশ বিষয়ে দুই দেশ একমত হলেও বাকি ২০ শতাংশ ইস্যু অমীমাংসিত রয়ে গেছে। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব এবং কিছু ব্যবসায়ী প্রতিনিধি আলোচনায় অংশ নেন।
এ বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, আমরা এখনও জানি না চূড়ান্তভাবে কী হবে। তবে আলোচনার শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ৩৫ শতাংশ নয়, ২০ শতাংশ শুল্কে যেতে পারে– এমন একটা গুঞ্জন আছে।
বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, আমরা ধারণা করছি, শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ২০ শতাংশ হারেই শুল্ক আরোপ করতে পারে। তবে এ হার ভিয়েতনামের চেয়ে বেশি হলে আমরা মার্কেট শেয়ারে পিছিয়ে পড়বো, কারণ ভিয়েতনামের রফতানি সক্ষমতা অনেক বেশি।
তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া ৪০ শতাংশ মূল্য সংযোজন, এটা ওভেনে সম্ভব নয়। ডেনিম ও নিটওয়্যারে আমরা সেটা পূরণ করতে পারি। কিন্তু সার্বিকভাবে সেটা দেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সাবেক সভাপতি এ মতিন চৌধুরী বলেন, চীনের তুলনায় আমাদের ওপর বেশি শুল্ক কেন? তা স্পষ্ট না। বিশেষ করে আমরা অনেক ফেব্রিক চীন থেকেই আমদানি করি।
তিনি মনে করেন, সরকার এখনই বিশেষ ফ্যাব্রিক উৎপাদনে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বৃহৎ প্রকল্প হাতে না নিলে ওভেন খাত মারাত্মক বিপদে পড়বে।
সম্ভাব্য প্রভাব: কী ঘটতে পারে সামনে?
তৈরি পোশাক রফতানির প্রবৃদ্ধি হঠাৎ থেমে যেতে পারে; ১০-১২ লাখ শ্রমিকের চাকরি ঝুঁকিতে পড়তে পারে; নতুন বিনিয়োগ থেমে যেতে পারে, পুরাতন প্রকল্প স্থগিত হতে পারে; বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও মুদ্রার মানে নেতিবাচক চাপ পড়তে পরে; সরকারি রাজস্ব আয় কমে যেতে পারে এবং ব্যাংক ঋণখেলাপির হার বাড়তে পারে।
সমাধানের উপায় কী?
যুক্তরাষ্ট্রে পেশাদার লবিস্ট নিয়োগ করে কৌশলগত চাপ সৃষ্টি; টেকনিক্যাল প্রস্তাবনায় দক্ষ দল গঠন; চুক্তিভিত্তিক দর কৌশলে পরিবর্তন; বিকল্প বাজার খোঁজা; দেশীয় ফেব্রিক উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জন এবং শ্রমিক ছাঁটাই রোধে প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা দেওয়া।
সময় এখন সাহসী সিদ্ধান্তের
যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত শুল্ক ঘোষণাটি কোনও সাধারণ অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নয়। এটি বাংলাদেশের জন্য কূটনৈতিক, কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক এক ত্রিমাত্রিক চ্যালেঞ্জ। প্রস্তুতি, আলোচনায় গতি, দৃশ্যমান কূটনৈতিক উদ্যোগ ও বাস্তবভিত্তিক টেকনিক্যাল প্রস্তাবনার মাধ্যমেই এই সঙ্কট মোকাবিলা সম্ভব। না হলে বাংলাদেশ হারাতে পারে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রফতানি বাজার, লাখো শ্রমিক হারাতে পারেন জীবিকা।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন