উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেও সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে রক্ষার পদক্ষেপকে ‘আত্মঘাতী’ বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিরা। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালার দুর্বলতা ও দায়িত্বহীন পরিদর্শনের সুযোগে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে অর্থ পাচারের ঘটনা নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তারা। ঋণ জালিয়াতি এবং ব্যাংক তছরুপে সহযোগীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর অবহেলার পরিচায়ক বলে অভিযোগ করেছেন আইএমএফ প্রতিনিধিদলের সদস্যরা।
৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের শর্ত পর্যালোচনায় ঢাকায় অবস্থানরত আইএমএফ মিশনটি সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করেন। যেখানে তারা বিএফআইইউ এবং ব্যাংকগুলোর শিথিলতা ও অবহেলার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এর আগে গত মঙ্গলবারের বৈঠকেও একই বিষয়ে আলোচনা হয়। প্রতিনিধিদল পরিস্থিতি দ্রুত উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ দিয়েছে।
বৈঠকে অংশ নেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আইএমএফের সদস্যরা দাবি করেছেন, প্রেসক্রাইবড পরিদর্শনের মাধ্যমে বানোয়াট তথ্য উপস্থাপন করে ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। গত কয়েক বছরে ব্যাংক খাতে ঋণ অনাচারের কারণে ব্যাপক অর্থ হরিলুট হয়েছে। ঋণের নামে চুরি ও ডাকাতি একসঙ্গে সংঘটিত হয়েছে। বিশেষ করে কয়েকটি গ্রুপ এবং কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি ব্যাংক খাতের নিয়মকানুনকে নিজেদের স্বার্থে ভেঙে ফেলেন। যার ফলে ব্যাংক খাত পঙ্গু হয়ে পড়েছে এবং সেখান থেকে দেখা দিয়েছে তারল্যসংকট। আরও কিছু ব্যাংক গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে টালবাহানা করছে, যার কারণে গ্রাহকদের আস্থা তলানিতে নেমে এসেছে।
তিনি বলেন, এ পরিস্থিতিতে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সংকটগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে হাজার হাজার কোটি টাকার নগদ সহায়তা দিয়েছে, যা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিতে পারে। উসকানি নিয়ন্ত্রণে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহীত পদক্ষেপগুলোর কিছু দুর্বলতা আইএমএফ ‘রেড মার্ক’ করে চিহ্নিত করেছে এবং ব্যাংকিং খাতে লুটপাটের কড়া নজরদারি নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছে। আইএমএফের মতে, টাকা ছাপানো একটি আত্মঘাতী ও গণবিরোধী পদক্ষেপ, যা পরিস্থিতি আরও খারাপ করতে পারে।
এদিকে প্রতিনিধিদলটি বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) শিথিলতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিশেষত গত ১৫ বছরে ক্ষমতার অপব্যবহার করে একটি প্রভাবশালী মহল বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পরও বিএফআইইউ কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে বলে তারা সন্দেহ প্রকাশ করেছে। আইএমএফ পাচারে সন্দেহভাজন কিছু হিসাব তলব, লেনদেনে স্থিতাদেশ এবং জব্দের মতো পদক্ষেপের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার বিষয়ে বিএফআইইউর সদস্যদের কাছে স্পষ্ট ব্যাখ্যা চেয়েছে। বৈঠকে অংশগ্রহণকারী একাধিক সূত্রের তথ্যমতে, আইএমএফ এ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের জন্য চাপ দিয়েছে।
জানতে চাইলে অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, ‘এ অবস্থায় ব্যাংক খাতে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে সামনে দেশের অর্থনীতি গভীর সংকটে পড়বে। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকারের উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক সদিচ্ছা অত্যন্ত জরুরি। ব্যাংক লুটেরা এবং খেলাপি ঋণগ্রহীতা এবং অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন, যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।’
বৈঠকে উপস্থিত অপর একটি সূত্র জানায়, ব্যাংকগুলোর নিয়মনীতি পরিপালনে ঘাটতি, ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি, পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্বহীনতা এবং আইন প্রয়োগে বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বল ভূমিকা আইএমএফের কাছে দায়িত্বে অবহেলার অংশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। আইএমএফ ব্যাংকগুলোর উন্নতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহীত পদক্ষেপ যাচাই-বাছাই করছে। তারা ব্যাংকগুলোর ক্যামেল রেটিংয়ের আওতায় মূলধন পর্যাপ্ততা, সম্পদের গুণগত মান, ব্যবস্থাপনা, মুনাফাজনিত আয়, তারল্য এবং বাজারের ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ ও তদারক কার্যক্রমের কার্যকারিতা পর্যালোচনা করছে।
এছাড়া ঋণ আদায়ের সমস্যা, গ্রাহকের অবস্থান এবং বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তারা মতামত দিয়েছে এবং ব্যাংকগুলোর ঋণের চাহিদা এবং গ্রাহকের আস্থা ফেরানোর উদ্যোগের বাস্তবতার প্রতি নজর দিয়েছে। আইএমএফের পক্ষ থেকে খেলাপি ঋণের মান, পরিমাণ ও লক্ষ্য অর্জন নিয়ে কড়া মতামত প্রদান করা হয়েছে; যা ব্যাংকিং খাতের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
আরেক কর্মকর্তা জানান, বেনামি ও জামানতবিহীন ঋণ দেওয়ার ফলে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে গৃহীত পদক্ষেপ, নীতিমালার দুর্বলতা এবং সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে ব্যাংকের নির্বাহী এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালার শিথিলতা, পরিদর্শনে ত্রুটি এবং অর্থঋণ আদালতের কার্যকারিতা জোরদারে তাঁরা আরও মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এ ছাড়া ডলারের রেট, আমদানি-রপ্তানির আড়ালে পাচার, কার্যকর মুদ্রানীতি প্রণয়ন এবং পরবর্তী ১২ মাসের জন্য বেঞ্চমার্ক কাঠামো নির্ধারণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা বলেন, আইএমএফের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ ব্যাংককে তাৎক্ষণিক কিছু পরামর্শ দিয়েছেন এবং কিছু বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে অতিরিক্ত তথ্য চেয়েছেন।
সম্প্রতি প্রকাশিত শ্বেতপত্রের খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত ১০টি ব্যাংক বর্তমানে টেকনিক্যালি দেউলিয়া এবং সংকটে রয়েছে। সিপিডি জানিয়েছে, কিছু ব্যাংক কার্যত মৃত এবং অনেক ব্যাংক ‘ক্লিনিক্যালি ডেথ’ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরও একই মন্তব্য করেছেন, ১০টি ব্যাংক তারল্যসংকটে এবং দেউলিয়ার পথে যাচ্ছে। এ ছাড়া গত ২ নভেম্বর টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান দাবি করেন, প্রতিবছর ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়।
সূত্র: আজকের পত্রিকা