রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ভিন্ন প্রেক্ষাপটে উদযাপিত হতে যাচ্ছে এবারের বিজয় দিবস। যথাযোগ্য মর্যাদায় রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবসটি উদযাপনে এবছর দেশের সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সেই লক্ষ্যে নানাবিধ কর্মসূচিও হাতে নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। সাড়ম্বর আয়োজনে বরাদ্দও বাড়ানো হয়েছে প্রায় তিনগুণ। একইসঙ্গে জেলা-উপজেলায় জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা জানানোরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মহান বিজয় দিবসকে শুধু একটি গোষ্ঠী বা একক পরিবারের হাতে আটকে না রেখে এবছর এটিতে আপামর জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করা হবে। এজন্য এবছর ‘চার দেওয়ালের ভেতরে’ কুচকাওয়াজ ও ডিসপ্লে না করে আয়োজন করা হচ্ছে বিজয় মেলারও।
সরকার বিজয় দিবসের বিভিন্ন কর্মসূচি আয়োজনে গত বছরের চেয়ে তিনগুণ বরাদ্দ বাড়িয়েছে। গত বছর এই খাতে বরাদ্দ ছিল ৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। এ বছর বাড়িয়ে ৯ কোটি ২১ লাখ ২৫ হাজার টাকা করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। জেলা ও উপজেলাগুলোতেও পৃথক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় ৭৫ হাজার টাকা এবং জেলায় ১ লাখ টাকা করে বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। বুধবার (১১ ডিসেম্বর) আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে এ বিষয়ে সবাইকে জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
বিজয় দিবস উদযাপনে পাঁচ কমিটি
দিবসটি উদযাপনে এরইমধ্যে দেশের সব জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানিয়েছে, কর্মসূচিগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম নিতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করবে। কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য দুটি কমিটি এবং তিনটি উপকমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি দুটি হলো, ‘মহান বিজয় দিবস-২০২৪ উদযাপন উপলক্ষে স্টিয়ারিং কমিটি’ ও ‘মহান বিজয় দিবস-২০২৪ উদযাপন উপলক্ষে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে সশস্ত্র অভিবাদন ও পুষ্পস্তবক অর্পণ কমিটি’।
আর তিন উপ-কমিটি হলো- ‘মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার বাণী প্রস্তুতকরণ, পুষ্পস্তবক অর্পণ অনুষ্ঠান, বেতার ও টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরে আলোচনা ও বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ সংক্রান্ত উপ-কমিটি’, ‘জাতীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে নিরাপত্তা, ট্রাফিক ও পুলিশ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত উপ-কমিটি’ এবং ‘মহান বিজয় দিবস-২০২৪ উদযাপন উপলক্ষে আমন্ত্রণপত্র প্রস্তুত ও বিতরণ উপ-কমিটি।’
আয়োজন শুরু শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস থেকেই
জানা গেছে, ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে সব সরকারি-বেসরকারি ভবনে কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে। এ দিন জাতীয় পতাকা থাকবে অর্ধনমিত। রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুস্পস্তবক অর্পণ করবেন। এর পরে তারা যাবেন রাজধানীর রায়ের বাজারের বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে। সেখানেও তারা মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। দেশের সব জেলা-উপজেলায় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আলোচনা সভা করার নির্দেশনাও রয়েছে।
পরে ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসের দিন দেশের সব সরকারি-বেসরকারি ভবনে উত্তোলন করা হবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস ও মিশনগুলোতেও জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। সন্ধ্যায় দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সাজানো হবে বর্ণিল আলোকসজ্জায়।
আগের মতো এবছর জেলাগুলোর সার্কিট হাউজের চার দেওয়ালের মধ্যে অনুষ্ঠিত বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ হচ্ছে না। সরকারি সিদ্ধান্তে তা বাতিল করা হয়েছে। এর পরিবর্তে অনুষ্ঠিত হবে বিজয় মেলা। এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে সব ডিসি ও ইউএনওকে ইতোমধ্যেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এদিন সরকারি ছুটি থাকবে।
সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে চলছে প্রস্তুতি
রাজধানীর অদূরে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে আট দিন জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। মহান বিজয় দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে জনসাধারণের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে কর্তৃপক্ষ। রবিবার (৮ ডিসেম্বর) সকালে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধের মূল ফটকে এ সংক্রান্ত নোটিশ টানিয়ে দিয়েছে জাতীয় স্মৃতিসৌধ কর্তৃপক্ষ।
নোটিশে বলা হয়েছে, মহান বিজয় দিবস ২০২৪ উদ্যাপন উপলক্ষে জাতীয় স্মৃতিসৌধ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও ভিআইপি নিরাপত্তার জন্য আজ (রবিবার) থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত জাতীয় স্মৃতিসৌধে সব ধরনের দর্শনার্থীদের প্রবেশ বন্ধ থাকবে। অর্থাৎ আট দিন বন্ধ থাকবে জাতীয় স্মৃতিসৌধ। একইভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ। সেখানেও জনসাধারণের যাতায়াত বন্ধ রাখা হয়েছে।
সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব সচিব ইসরাত চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ‘মহান বিজয় দিবস-২০২৪ উদযাপন’ উপলক্ষে জাতীয় কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ওই সভার বরাত দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার নেতৃত্বে সেদিন উপস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ পরিবারের সদস্য, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। সাভারগামী ঢাকা-আরিচা এবং ঢাকা-আশুলিয়া-সাভার এ দুটি সড়কে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও উন্নয়ন করা হচ্ছে। দেশের সব জেলা এবং উপজেলায় দিনব্যাপী আড়ম্বরপূর্ণ বিজয় মেলা (চারু, কারু ও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত শিল্প পণ্যের) আয়োজন করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
থাকছে আরও নানা আয়োজন
অপরদিকে, শিশুদের জন্য মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম, খুলনা, মোংলা ও পায়রা বন্দর, ঢাকার সদরঘাট, পাগলা (নারায়ণগঞ্জ) ও বরিশালসহ বিআইডব্লিউটিসির ঘাটে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের সমন্বয়ের মাধ্যমে এককভাবে বা যৌথভাবে এবং চাঁদপুরে ও মুন্সীগঞ্জ লঞ্চঘাটে বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের জাহাজগুলো এককভাবে দুপুর ২টা থেকে ওইদিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত জনসাধারণের দর্শনের জন্য উন্মুক্ত রাখা হবে।
এ ছাড়াও স্ব স্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা) ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণে ক্রীড়া অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারসহ বিভিন্ন বেসরকারি বেতার ও টিভি চ্যানেলে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ভিত্তিক অনুষ্ঠানমালা প্রচার করা হবে। ঢাকাসহ দেশের সব জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সিনেমা হলে বিনা টিকিটে ছাত্রছাত্রীদের জন্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে সরবরাহ করা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র প্রদর্শনী এবং দেশের সর্বত্র মিলনায়তনে বা উন্মুক্ত স্থানে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হচ্ছে।
বিশেষ প্রার্থনা
মহান বিজয় দিবসে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত, মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সুস্বাস্থ্য এবং জাতির শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি কামনা করে সব মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ও অন্যান্য উপাসনালয়ে বিশেষ মোনাজাত ও প্রার্থনা করা হবে। দেশের সব হাসপাতাল, জেলখানা, বৃদ্ধাশ্রম, এতিমখানা, ডে কেয়ার ও শিশু বিকাশ কেন্দ্র এবং শিশু পরিবার ও ভবঘুরে প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশেষ খাবার সরবরাহ করা হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আশরাফুল আলম খান জানিয়েছেন, ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন এবং ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উদযাপন সরকারিভাবে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। সব প্রস্তুতি প্রায় শেষ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণপত্র বিলির কাজ চলছে। পুরোদমে চলছে বিজয় মেলা আয়োজনের কাজও। এটি দেশে প্রথমবার আয়োজন করা হচ্ছে। এ বছর ভিন্ন প্রেক্ষাপটে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও বিজয় দিবস। এ কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বলেন, মহান বিজয় দিবস শুধু একটি গোষ্ঠী বা কোনও পরিবারের একক কৃতিত্ব নয়। এটি সবার। আপামর জনসাধারণের। সে জন্যই আমরা এবছর চার দেওয়ালে বন্দি বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ কর্মসূচি বাতিল করেছি। আমরা দেশের ১৮ কোটি মানুষকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে সারা দেশে বিজয় মেলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ওই মেলায় চারু, কারু ও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত শিল্পপণ্যের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা রাখতে হবে। মেলায় থাকবে গ্রামীণ নানা ঐতিহ্যের সমাহার।
অন্যান্য বছরের মতো এবারও জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে সশস্ত্র বাহিনীর কোনোধরনের কুচকাওয়াজ ও ডিসপ্লে হবে না বলেও জানান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, তবে প্রতিটি জেলায়-উপজেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে স্থানীয় জেলা ও উপজেলা প্রশাসন। এ ছাড়া আগের সব ধরনের কর্মসূচি অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
‘এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দেশের সব ডিসি-ইউএনওকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দিয়েছি। এ জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সেসব অর্থ ছাড় করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগ এ দুটি দিবস পালনে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।’