ফায়ার সার্ভিসের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ

ডেস্ক রিপোর্ট
  ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩:০৯

দেশের যে কোনো দুর্যোগে সুনাম কুড়ানো ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ উঠেছে। নেপথ্যে সংস্থাটির বেশ কিছু কর্মকর্তা ও স্থানীয় দালাল শ্রেণির আওয়ামী লীগ নেতা। বিষয়টি গড়িয়েছে মামলা, দুদকের গণশুনানি পর্যন্ত। সরকারিভাবে জমি অধিগ্রহণ না করায় উঠছে বিতর্ক। ‘ডুবুরি সেবা’ না ‘কর্মচারী কল্যাণ’র নামে জমি দখল করে কেনার চেষ্টা করা হচ্ছে সেটিও স্পষ্ট নয়।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, ‘ফায়ার সার্ভিসের জমি প্রয়োজন হলে অধিগ্রহণ করবে। কিন্তু তারা প্রশাসনের পাশাপাশি পেশিশক্তি দিয়ে আগে দখল করছে। পরে ‘দালাল’ দিয়ে কিনছে। এতে প্রকৃত মূল্য পাচ্ছে না ক্রেতা। আসছে না নিষ্কণ্টক জমিও। তাৎক্ষণিক সুবিধা পেতে অন্যের কাছে বিক্রিত জমিও দলিল করে দিয়েছে দালাল। এমনকি আট একর দখলে নিয়ে জোরপূর্বক উঁচু সীমানাপ্রাচীর দিয়েছে। অথচ ৩০ নভেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত কিনেছে মাত্র চার একর।
জোরপূর্বক সীমানাপ্রাচীর দেওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে ভেতরে বসবাসকারীদের যাতায়াত। বিঘ্ন হচ্ছে চাষাবাদ। বৈধ মালিকদের বসতবাড়ি ছাড়তে ও চাষাবাদ বন্ধ করতে ফায়ার সার্ভিসের পোশাকে ভয়ভীতি প্রদর্শন, শারীরিক নির্যাতন ও গুম করারও ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ।
স্থানীয়রা বলছেন, আমাদের বাড়ির ওয়াশরুমেও যেতে দিচ্ছে না। রোপণ করা ধান তুলে ফেলছে। নাগরিক কোনো অধিকার দিচ্ছে না। জমি অধিগ্রহণ করে না, ন্যায্য দামে কেনেও না। আবার কোথাও বিক্রিও করতে দিচ্ছে না। খাজনাও দিতে পারছেন না।
তবে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ও কর্মকর্তারা বলছেন, ‘জমি তো তুলে নিয়ে যাচ্ছি না। জমি জমির জায়গায়ই থাকছে। আমরা বাউন্ডারি দিচ্ছি তাতে কী সমস্যা? যারা জমির মালিক, তারা প্রমাণসাপেক্ষে মূল্য নিয়ে যাবে।’ আর জমির মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক বলছেন, ‘তারা শান্তিপূর্ণ সমাধান চান।’
বিগত সরকারের আমলে তারা এই লুটপাট করেছে। আমাদের সব দলিল আছে। চৌহদ্দি দেওয়া আছে। খতিয়ান করা আছে। খাজনাও দেওয়া আছে। বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাদের কাছে আমরা আমাদের অধিকার চাই। সাম্য ও ন্যায়বিচার চাই। এই সরকারের কাছে আমরা অধিকার না পেলে কখনো অধিকার ফিরে পাবো না।- ভুক্তভোগী শহীদুল্লাহ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি অন্যায়, শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এর দায় কোনোভাবেই ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এড়াতে পারে না।

সরেজমিনে যা পাওয়া গেলো
সরেজমিনে দেখা যায়, কক্সবাজারের ইনানী সৈকতের কাছাকাছি মেরিন ড্রাইভ সড়কের কোলঘেঁষে আট একর এলাকায় চলছে কর্মযজ্ঞ। সাইনবোর্ডে লেখা- ‘ক্রয় সূত্রে এই জমির মালিক ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স’। তিনদিকে দেওয়ালে ঘেরা, একদিকে টিন। কিন্তু দেওয়াল তোলারও কাজ চলছে। তদারকি করছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ভেতরে মানুষের বাড়ি, জমিতে ধান। তবে ভেতরে বসবাসকারী নাগরিকদের জন্য রাখা হয়নি কোনো পথ। বরং তারা অভিযোগ করছেন, প্রতিনিয়ত তাদের শারীরিক নির্যাতনসহ নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে জমির দখল ছেড়ে দিতে। কলেজপড়ুয়া মেয়েও রেহাই পাচ্ছে না ফায়ারকর্মী ও তাদের সহযোগীদের নির্যাতনের হাত থেকে।
ফায়ার সার্ভিসের সীমানাপ্রাচীর তোলা এলাকার ভেতরে ঢুকলে খালেদা বেগম নামে একজন অভিযোগ করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখানে আমাদের বাড়িঘর ও চাষের জমি আছে। চারদিকে দেওয়াল দিয়ে ঘেরাও করে ফেলছে। বের হতে পারি না। বন্যায় পানির নিচে পড়ে ছিলাম। তারপরও তারা আমাদের অধিকার বঞ্চিত করেছে। আমরা রাস্তার জন্য বিচার চাইলে চেয়ারম্যানসহ সবাই মিলে বসে রাস্তা দিতে বলছে। কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা মানে না।’
তিনি বলেন, ‘এ পর্যন্ত সাতবার আমাদের ওপর হামলা করেছে। আমার কলেজপড়ুয়া মেয়ের গায়েও আঘাত করেছে। ইজ্জত নষ্টের হুমকি দিয়েছে। থানায় মামলা বা অভিযোগ নিতে চায় না। অনেক দেন-দরবার করে একবার অভিযোগ নিলেও সামাজিক মর্যাদার জন্য সেখানে মেয়ের বিষয়টি উল্লেখ করিনি। মেয়ের বাবাকে একবার তুলে নিয়ে গেছে। কয়েকবার তাকে গুম করার চেষ্টা করেছে। আমরা তাকে লুকিয়ে রাখি। এ নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বিচার চেয়েও পাইনি। আমরা আমাদের ভিটেমাটিতে নিরাপদে থাকতে চাই।’
আবুল হোসাইন নামে আরেক ভুক্তভোগী বলেন, ‘আমাদের এখানে পৈতৃক সূত্রে ৬০ শতক জমি আছে। আর আমার বড় ভাইয়ের খরিদ সূত্রে জমি আছে ১০ শতক। মোট ৭০ শতক। আমরা এখানে চাষাবাদ করি। এখনো ধান আছে। স্বৈরাচারী সরকারের আমলে তারা (ফায়ার সার্ভিস) জোরপূর্বক দেওয়াল তুলেছে। চাষাবাদ করতে গেলে তারা বাধা দেয়।’
প্রতিকার চেয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা এসিল্যান্ডের কাছে গেছি। তিনি আমাকে বলেছেন, আমাদের ওপর চাপ আছে। আমরা পারছি না। আপনারা আদালতে যান। পরে আমরা কোর্টে মামলাও করেছি।’

মেয়েকে পরীক্ষা দিতে যেতে দেয়নি
বাড়িওয়ালা আবদুল মাজেদ বলেন, ‘১৯৪৩ সাল থেকে পৈতৃকভাবে আমরা এখানে জমির মালিক। বসবাস ও চাষাবাদ করি। আমার দাদার দুই একর জমি ছিল। সেখান থেকে বাবা ভাগ পায় ৪০ শতক। ক্রয় সূত্রে আমার বাবা ৭৬ শতকের মালিক। বাবা থেকে আমি এসব সম্পত্তি (১১৬ শতক) পাই। ১৬ শতকে বাড়ি করে বাকিটুকুতে ধান চাষ করি। তারা হুমকি-ধমকি দিয়ে আমার থেকে দখল নিয়ে যায়, আমি আবার লড়াই করে চাষ করি। এভাবে চলছে। চারদিক থেকে বন্ধ করে আমাদের চলাচল করতেও দেয় না। দেওয়াল দিয়ে আটকে রাখছে। আমার মেয়ে একটার অনার্স পরীক্ষা ছিল, তাকেও যেতে দেয়নি। পরে থানায় গিয়ে অভিযোগ দিয়ে তার যাতায়াতের পথ খুলেছি।’
তিনি বলেন, ‘আমাকে সাতদিনের মধ্যে জায়গা থেকে দখল ছেড়ে উঠে যেতে হুমকি দিয়েছে। মারধর করে। দেওয়াল করার সময়ও মারধর করেছে। ট্রেনিংয়ের নামে ২শ লোক এসে আমাদের ওপর হামলা করেছে। আমরা অসহায় মানুষ। আমাদের কাগজ আছে, পৈতৃক ভিটায় নিরাপদে থাকতে চাই।’
শহীদুল্লাহ নামে এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘পৈতৃক সূত্রে ১৯৮৪ সাল থেকে আমরা এখানে থাকি। এখানে এমন কোনো দাগ নেই যেখানে আমার জমি নেই। আমার নিজের তিন একর এবং আত্মীয়-স্বজনের অংশ মিলে প্রায় চার একর ৮৮ শতাংশ জমি এখানে। আমাদের থেকে এক শতাংশ জমিও না কিনে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বাউন্ডারি করে ফেলছে। সাড়ে তিনশ ফায়ার কর্মকর্তাকে ট্রেনিংয়ের নামে এখানে এনে, পতিত সরকারের ক্ষমতা ব্যবহার করে, জোরপূর্বক আমাদের লোকদের মেরে, নারীদের গায়ে হাত দিয়ে, চেঁচিয়ে এখান থেকে বের করে দিয়ে ওরা এ জমি দখল করেছে। র‌্যাবের সহযোগিতা নিয়েছে। ১৪৪ ধারাও তারা তোয়াক্কা করেনি। আমরা একটা শোকজ নোটিশ পাঠিয়েছি, এটাও তোয়াক্কা করেনি। বাংলাদেশ সরকারের কোনো নির্দেশনা-আইন মানেনি।’
জমির মালিকানা নেই বা আগেই বিক্রি করে ফেলা হয়েছে, এমন জমিও কিনেছে ফায়ার সার্ভিস। এবং তাদের নামে নামজারি খতিয়ানটিও নিয়মমাফিক হয়নি। বিষয়টি আমার নজরে আসছে। এটা আমার আগের অফিসারের সময়ে হয়েছে।- উখিয়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি) যারীন তাসনিম তাসিন
তিনি বলেন, ‘বিগত সরকারের আমলে তারা এই লুটপাট করেছে। আমাদের সব দলিল আছে। চৌহদ্দি দেওয়া আছে। খতিয়ান করা আছে। খাজনাও দেওয়া আছে। আমরা আমাদের নাগরিক অধিকার চাই। বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাদের কাছে আমরা আমাদের অধিকার চাই। সাম্য ও ন্যায়বিচার চাই। এই সরকারের কাছে আমরা অধিকার না পেলে কখনো অধিকার ফিরে পাবো না।’
প্রতিকারে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন কি না? জবাবে শহীদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা দুদক, ভূমি মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ফায়ার সার্ভিস হেড অফিস, স্থানীয় জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস অফিসসহ সব জায়গায় এ বিষয়ে অভিযোগ করেছি। সবগুলো রিসিভ কপি আছে। ফায়ার সার্ভিস আমাদের বলেছে, আপনাদের জমি আমরা নেবো, তবে মিডিয়ার মাধ্যমে আসেন। আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে তো জমি দেবো না। কারণ মিডিয়া আমাদের খুবই নিম্ন রেট বলে। বিঘা ২০-৩০ লাখ টাকা দিতে চায়। অথচ ফায়ার সার্ভিসের কাছে তারা বিঘাপ্রতি ২-৩ কোটি টাকায় বিক্রি করে।’
তিনি একটি ম্যাপ দেখিয়ে বলেন, ‘এখানে বাউন্ডারিতে জমি আছে আট একর। কিন্তু ফায়ার সার্ভিস কিনেছে তিন একর। এর মধ্যে ঝামেলা আছে। ভুয়া মালিক দেখিয়ে দলিল নিয়েছে। অনৈতিক প্রক্রিয়ায় তিন একর দলিল করে নিলেও দখল করছে আট একর।’
সরকারি প্রতিষ্ঠান তো জমি অধিগ্রহণ করে, কেনে না। এটা কেনার কারণ আপনাদের কাছে কী মনে হয়েছে? জবাবে শহীদুল্লাহ বলেন, ‘এটা আমরা তাদের কাছে জানতে চেয়েছি। তারা সদুত্তর দিতে পারেনি। তবে আমরা দেখছি, জমি কেনে কল্যাণ তহবিলের নামে। আবার এখানে সাইনবোর্ড দিচ্ছে ফায়ার সার্ভিসের। কাজও করে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পোশাক পরে। এখানে একটা সূক্ষ্ম প্রতারণা আছে।’

রেকর্ডে যা আছে
সরকারি রেকর্ড, সৃজিত খতিয়ান, দলিল ও খাজনাখারিজের তথ্য অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, ‘মহাপরিচালক, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর ও সভাপতি, কেন্দ্রীয় কমিটি, কর্মকর্তা ও কর্মচারী কল্যাণ তহবিল’র নামে গত ০৫/০৪/২০২৩ ইং তারিখে ৭৯৮, ৭৯৯ ও ৮০০ নম্বর দলিল মূলে তিন একর ১৯ শতক জমি কেনে। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন দাতা একই জমি যথাক্রমে ১৪ বছর, ৬ মাস আগে বিক্রি করেছেন। একজন তো বাবার হেবা করা জমি আগে একজনের কাছে বিক্রি করে আবার ওয়ারিশ সূত্রে একই জমির মালিক দেখিয়ে ফায়ারের ক্ষমতায় খতিয়ান সৃজন করে দলিল দিয়েছেন। নানান অনিয়মের এই দলিল দিয়ে ভূমির জমাখারিজ হওয়ার সুযোগ না থাকলেও এসিল্যান্ডকে চাপ দিয়ে খতিয়ান সৃজন করেছে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ। যার নম্বর ৯০৫৪।
এ বিষয়ে উখিয়ার বর্তমান সহকারী কমিশনার (ভূমি) যারীন তাসনিম তাসিন তার সহকর্মীদের মাধ্যমে সব নথি ঘেঁটে স্বীকার করেন, ‘জমির মালিকানা নেই বা আগেই বিক্রি করে ফেলা হয়েছে, এমন জমিও কিনেছে ফায়ার সার্ভিস। এবং তাদের নামে নামজারি খতিয়ানটিও নিয়মমাফিক হয়নি। বিষয়টি আমার নজরে আসছে। এটা আমার আগের অফিসারের সময়ে হয়েছে।’
উক্ত দলিল ও খতিয়ানের বাইরে আরও দুটি আলাদা খতিয়ান মূলে বেশ কিছু জমির মালিকানা দাবি করছে ফায়ার সার্ভিস। তাদের দাবি করা পুরো জমির পরিমাণ চার একর। কিন্তু জোরপূর্বক দখলে নিয়েছে আট একর। এর মধ্যে স্থানীয় শহীদুল্লাহর ১২০ শতক, ফজলুল হকের (পাওয়ারে মনিরা বেগম) ১০৬ শতক, আবুল হোসেনের ৪০ শতক, আব্দুর রশিদের ৪০ শতক, আবুল হোসাইন গংদের ৭০ শতক, আব্দুল মাজেদের ৪০ শতক, গোলাম নবীর ৩২ এবং মৌলভি মাহবুব গংদের ৪০ শতাংশ। মোট ৪ একর ৮৮ শতাংশ। এসব ভুক্তভোগী নানান সময়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেও প্রতিকার পায়নি।

শুনানি করে চুপসে যায় দুদক
এ নিয়ে নানা জায়গায় ধরনা দিয়ে কোনো প্রতিকার না পেয়ে দুদকে যান ভুক্তভোগী জমির মালিকরা। দুদকের তৎকালীন কমিশনার জহুরুল হক উপস্থিত থেকে সব পক্ষকে নিয়ে শুনানি করেন। শুনানি শেষে তিনি বলেন, যাদের বিরুদ্ধে সত্য অভিযোগ করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে যেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়, এটা আমরা বলে দিয়েছি। দুদক অফিসকেও জানিয়ে দিয়েছি। ডিসির রিপোর্ট পাওয়ার পর দুদক অফিস একত্র করে ডেকে নেবে।

‘ডুবুরি সেবা’ না ‘কর্মচারী কল্যাণ’?
দুদকের সেই শুনানিতে ফায়ার সার্ভিসের কক্সবাজার অফিসের তৎকালীন প্রধান অতীশ চাকমা বলেন, “কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ডুবুরি সেবা দেওয়ার জন্য ডিজি মহোদয় একটা জমির ব্যবস্থা করতে বলেন। আমি ইনানীতে জমি দেখে প্রস্তাবনা দেই। সেটি একনেকে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার জন্য অধিগ্রহণ বাতিল হয়ে যায়। পরে স্বরাষ্ট্র সচিব মহোদয় নিজেই জমি পরিদর্শনে যান। তিনি সেখান থেকেই ‘কল্যাণ তহবিল’র নামে কিনতে বলেন। আমরা জমি যাচাই-বাছাই করে ছয় একর কেনার প্রক্রিয়া করেছি।”
জমি তো কক্সবাজারের ইনানিতেই রয়েছে। জমি তো এমন নয় যে, আমরা প্লেনে করে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। তাতে সমস্যা কী? আমরা শুধু আমাদের ডিমারকেশন (সীমানির্ধারণ) বসাচ্ছি, তাতে মহল্লার লোকজন বুঝতে পারবে, এতটুকু জমি ফায়ার সার্ভিস নিচ্ছে। তখন তাদের মধ্যে যারা ভেতরে পড়বে, তারা আসবে, কাগজ দেখাবে যে আমারটা ভেতরে পড়ছে, আমার কাগজ এই, আমারটা নিয়ে নেন।- ফায়ার সার্ভিসের ক্রয় কমিটির সভাপতি সহকারী পরিচালক ইকবাল বাহার বুলবুল
এদিকে, ফায়ার সার্ভিসের ১৮/০১/২৪ এর একটি সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, ‘ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তা/কর্মচারী কল্যাণ তহবিলের অর্থ থেকে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কল্যাণার্থে কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার ইনানী মৌজায় এরই মধ্যে ৪ দশমিক ৭৪ একর জমি কেনা হয়েছে।’ ওই সভায় অবশিষ্ট জমি কিনতে ৯ দফা নির্দেশনা দিলেও সেটি প্রতিপালন করা হয়নি।
নেপথ্যে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও দালাল শ্রেণির আওয়ামী লীগ নেতা
ফায়ার সার্ভিসের ফিল্ড অফিসার মামুন ও সংস্থাটির ক্রয় কমিটির সভাপতি ইকবাল বাহার বুলবুল এ কাজে সম্পৃক্ত বলে অনুসন্ধানে জানা যায়। তাদের সঙ্গে সহযোগী জালিয়া পালং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু তাহের ও তার ছেলে ইউসুফ নূর এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা কালো জমির ওরফে মানবপাচারকারী জমির। এছাড়া জমির দালাল মোস্তাক ও জসিম মাস্তান। এরা মূলত একটি সিন্ডিকেট। ৫ আগস্টের পর এদের কারও খোঁজ নেই। ফায়ার সার্ভিসের ক্ষমতা ব্যবহার করে ভয়ভীতি, মারধরসহ নানানভাবে চাপ প্রয়োগ করে কম মূল্যে (ন্যায্য দামেরও অর্ধেক) গ্রাহক থেকে জমি নিয়ে চড়া মূল্যে (দ্বিগুণ-তিনগুণ) ফায়ার সার্ভিসের কাছে বিক্রি করে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এই চক্রটি নিজেদের পকেট ভারী করতে ভুল বুঝিয়ে ফায়ার সার্ভিসের তৎকালীন ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মইন ও আইসিটি প্রতিমন্ত্রী পলককেও ব্যবহার করেছে। ডিজি ও প্রতিমন্ত্রীর প্রভাব ও তদবিরে সায় দিয়েছেন সুরক্ষা সেবা বিভাগের তৎকালীন একজন উপসচিব, তৎকালীন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক, কক্সবাজার জেলা ভূমি কর্মকর্তা, তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ফায়ার সার্ভিসের কক্সবাজার প্রধান অতীশ চাকমা।
এ নিয়ে নানান সময়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা গণমাধ্যমে নানান রকম কথা বলেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে সংস্থাটির ক্রয় কমিটির সভাপতি সহকারী পরিচালক ইকবাল বাহার বুলবুল গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন। জোরপূর্বক এই দেওয়াল নির্মাণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জমি তো কক্সবাজারের ইনানীতেই রয়েছে। জমি তো এমন নয় যে, আমরা প্লেনে করে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। তাতে সমস্যা কী? আমরা শুধু আমাদের ডিমারকেশন (সীমানির্ধারণ) বসাচ্ছি, তাতে মহল্লার লোকজন বুঝতে পারবে, এতটুকু জমি ফায়ার সার্ভিস নিচ্ছে। তখন তাদের মধ্যে যারা ভেতরে পড়বে, তারা আসবে, কাগজ দেখাবে যে আমারটা ভেতরে পড়ছে, আমার কাগজ এই, আমারটা নিয়ে নেন।’
ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় ইনানী প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক ও ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার সাফায়েত হোসেনের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা যেখানে বাউন্ডারি দিয়েছি, সে জায়গাটি আমাদের। আমরা যাচাই করেই কিনেছি। তবে মাঝখানে কিছু জায়গা আছে ভিন্ন মালিকের। তাদের কেউ দেশের বাইরে আছে। কেউ দেশে। তারা চাষবাস করে খাচ্ছে। তাদের আমরা বলেছি, তারা কাগজপত্র আনলে ফায়ার সার্ভিস উপযুক্ত দাম দিয়ে নিয়ে নেবে।’
এ বিষয়ে একই সুরে কথা বলেন ফায়ার সার্ভিস কক্সবাজারের উপ-সহকারী পরিচালক মো. তানহারুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘জমিজমা তো সরাসরি কেনা যায় না। ব্রোকার লাগে। আমি যতটুকু জানি জমির নামে একজনের সঙ্গে আমাদের ক্রয় কমিটির চুক্তি হয়েছে। আমাদের এত শতাংশ বা একর জমি এত টাকার বিনিময়ে দেবে। সে কত দিয়ে নেবে, সেটা আমাদের বিষয় নয়। সেভাবেই ওই লোক আমাদের জমি কিনে দিয়েছে। আমরা কিনেছি। এখানে কিছু লোকের মালিকানা নিয়ে সমস্যা আছে, সেটা কেনা যাচ্ছে না। এগুলো নিয়েই প্রশ্ন উঠছে।’
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি যতটুকু জানি ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ তহবিলের নামে জমি কিনছে। তবে, কাউকে মারধর করা বা জোর করে নেওয়া তো যে কারও জন্যই বৈধ নয়। এটা অন্যায়।’
চাপের মুখে নামজারির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সেটা মিসকেস করার সুযোগ আছে। তবে, আমি বিষয়টি শুনবো। দেখবো আমাদের কিছু করার আছে কি না।’
বিষয়টি নিয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহেদ কামাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটা আমাদের কল্যাণ তহবিল থেকে কেনা হচ্ছে। ওখানে আট একর জায়গা ঘেরাও করা হয়নি। যতটুকু কেনা হয়েছে, ততটুকু ঘেরাও করা হয়েছে। যে জায়গায় বিতর্ক আছে, সেখানে বাউন্ডারি দেওয়া হয়নি। যারা মালিক তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে।’
তার দাবি, ‘অনার্স পড়ুয়া ছাত্রীকে আটকে দেওয়ার ঘটনা ঘটেনি। আর জমির মালিকদেরও মারধর করা হয়নি। বরং ওনাদের (জমির মালিকদের) হামলায় আমাদের কিছু কর্মী আহত হয়েছে। এ ঘটনায় ফৌজদারি মামলাও আমাদের পক্ষ থেকে করা হয়েছে। ওখানকার যে সমস্যা, সেটার শান্তিপূর্ণ সমাধান আমরা চাই। সেজন্য একটা কমিটিও করে দেওয়া হয়েছে। কমিটি কাজ করছে।’
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অগ্নি অনুবিভাগের (ফায়ার সার্ভিসের তদারক) দায়িত্বে নিয়োজিত অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ সরকার জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভূমি অধিগ্রহণের বাইরে কিনতে হলে আমাদের অনুমতি নেওয়ার কথা। নিয়েছে কি না আমার জানা নেই। আমি নতুন আসছি। খোঁজ নেবো।’

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘যে কোনো সম্পত্তি তার মালিকের ভোগ-দখলের অধিকার আছে। এটা সংবিধান স্বীকৃত। শুধু সরকার জনস্বার্থে অধিগ্রহণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে মালিককে টাকা দিয়ে অধিগ্রহণ করতে পারবে। কিন্তু জোর করে পরের জমিতে প্রতিষ্ঠান তৈরি করবেন, এটা সম্পূর্ণ বেআইনি। যারা করছে, তারা সার্ভিসের লোক হলে সার্ভিস রুলস ভঙ্গের কারণেও ব্যবস্থা হতে পারে। মালিকরা বিষয়টি কোর্টের নজরে আনতে পারেন।’
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ও দুদক সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ইফতেখারুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিস জাতীয় স্বার্থে কর্মরত একটা বাহিনী। তারা যে কাজটা করছে, তারা শুধু আইনের লঙ্ঘনই করছে তা নয়, বহুমাত্রিক অনিয়মের মাধ্যমে মানুষের ওপর অত্যাচার করছে রীতিমতো। ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। যার অপর নাম দুর্নীতি, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি। ফায়ার সার্ভিসের মতো সংস্থার এমন কার্যক্রম যে কোনো প্রেক্ষিতেই অগ্রহণযোগ্য।’
তিনি বলেন, ‘কর্তৃত্ববাদী সময়ে কোনো কারণে তৎকালীন মহাপরিচালক বা ফায়ার সার্ভিস যদি করে, সেটার দায় আমরা তাদের দিতে পারতাম। কিন্তু এখন পট পরিবর্তনে পরও যেহেতু বর্তমান কর্তৃপক্ষ একই ধারা অব্যাহত রেখেছেন, মানুষের ওপর অন্যায় করছেন, মানুষের অধিকার খর্ব করছেন। এটা বৈষম্যবিরোধী চেতনার পরিপন্থি এবং এটা তাদের (ফায়ার সার্ভিস) মূল ম্যান্ডেটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এর সঙ্গে যারা জড়িত, ফায়ার সার্ভিসের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ এর দায় এড়াতে পারে না। এমনকি তাদের পর্যবেক্ষক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও দায় এড়াতে পারে না কোনোভাবেই।’
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমি মনে করি, এখানে সার্বিকভাবে অনিয়ম করা হচ্ছে। মানুষের ওপর অনাচার ও অধিকার খর্ব করা হচ্ছে, এটার সুস্পষ্ট জবাবদিহি ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার হওয়া উচিত। যাদের জমি দখল করা হয়েছে, তাদের ক্ষতিপূরণসহ জমি ফেরত দিতে হবে। ক্ষতিপূরণ ফায়ার সার্ভিসকেই দিতে হবে।’