কঠিন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প

ডেস্ক রিপোর্ট
  ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩:৫৪

বাংলাদেশের পোশাকশিল্প বর্তমানে এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। একদিকে গ্যাস-বিদ্যুতের ঘাটতি, দুর্বল ব্যাংকিং ব্যবস্থা, শ্রমিক অসন্তোষ এবং অপর দিকে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি—এসব সমস্যায় পড়ে দেশের পোশাক কারখানাগুলো আজ চরম সংকটের মধ্যে রয়েছে। মুনাফা প্রায় তলানিতে চলে যাওয়ার পাশাপাশি উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার ফলে ব্যবসায়ীরা দিন দিন বড় আর্থিক চাপের মধ্যে পড়েছেন। এসব সমস্যার মধ্যেই ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’-এর মতো যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের দাম প্রায় ৮ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়েছে। ফলে অতীতে কিছু ভালো অবস্থানে থাকা কারখানাগুলোও এখন সংকটে পড়েছে।
ব্যবসায়ীদের মতে, বিশ্ববাজারে সবচেয়ে বড় পোশাক রপ্তানির গন্তব্য দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের মোট পোশাক রপ্তানি আয়ের ২০ থেকে ২২ শতাংশই আসছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। কিন্তু বর্তমানে এই মার্কেটেই বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে। একদিকে দেশে গত এক বছরে প্রায় ৫০ শতাংশ উৎপাদন খরচ বেড়েছে। অন্যদিকে রপ্তানি বাজারগুলো পোশাকের দাম বাড়ানোর পরিবর্তে উল্টো কমিয়েছে। এতে অনেক কারখানা, বিশেষ করে ছোট এবং মাঝারি সাইজের প্রতিষ্ঠানগুলো এখন লোকসানে চলছে।
দাম কমানোর প্রভাব
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সাধারণত পাঁচ ধরনের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়। ওটেক্সার তথ্যে দেখা যায়, এখানে দেশের তৈরি এসব পোশাকের দাম বর্তমানে ৩ দশমিক ৮ থেকে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। বিশেষ করে ছেলেদের কটন ওভেন ট্রাউজার ৪ দশমিক ৪ শতাংশ, কটন ওভেন শার্ট ৩ দশমিক ৮ শতাংশ এবং কটন নিট টি-শার্টের দাম কমেছে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। এক বছর আগে এসব পণ্যের দাম যা ছিল, এখন সেই একই পণ্য তার থেকে প্রায় ৭ দশমিক ৭ শতাংশ কম দামে আমদানি করছে। এই দাম কমানোর ফলে বাংলাদেশি পোশাকের রপ্তানি আয়ও কমেছে। গত বছর যেখানে ৬ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছিল, সেখানে চলতি বছর একই সময়ের মধ্যে রপ্তানি হয়েছে ৬ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার, যা ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ কম। চলতি অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে দেশের পোশাক রপ্তানি কমেছে ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
ব্যবসায়ীরা জানান, তাঁদের প্রধান উদ্বেগের বিষয় হলো যত দিন না পোশাকের দাম বাড়ানো হয়, তত দিন এই সংকট কাটানো সম্ভব হবে না। বিশেষ করে নতুন মজুরিকাঠামো বাস্তবায়ন এবং ৯ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দেওয়া অনেক কারখানার জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেক কারখানা তাদের শ্রমিকদের বেতন দিতে গিয়ে সংকটে পড়েছে এবং কিছু কারখানা বন্ধ হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
ব্যবসায়ীদের মতামত
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানিয়েছেন, ‘ভিয়েতনামের পণ্যের শুল্ককাঠামো বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম, যার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তারা আমাদের তুলনায় ভালো সুবিধা পাচ্ছে। বাংলাদেশের পোশাকের দাম কমানোর পর আমাদের উৎপাদন খরচ আরও বেড়েছে। এটি দেশের পোশাকশিল্পের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে আশুলিয়ার বাইরের কারখানাগুলোর জন্য এই পরিস্থিতি আরও কঠিন। অতীতের মজুরিকাঠামোও অনেক কারখানা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এমন অবস্থায় অনেক কারখানাই নতুন মজুরিকাঠামোর সঙ্গে ৯ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট বাস্তবায়ন করতে পারবে না।’
পোশাক খাতের এক্সপার্ট এবং ডেনিম এক্সপার্টস লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, পোশাকের দাম কমানোর কারণে শ্রমিকদের মজুরিকাঠামো বাস্তবায়ন করা এখন আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। বেশির ভাগ কারখানা যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে লোকসানে চলছে এবং কিছু কারখানা মুনাফা করার চেষ্টা করলেও তা মাত্র ২-৩ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে।
নতুন মজুরিকাঠামো
বাংলাদেশের পোশাকশ্রমিকদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে গত বছর মজুরিকাঠামো ৮ হাজার থেকে ১২ হাজার ৫০০ টাকা করা হয়েছিল। এ ছাড়া চলতি মাস থেকে ৯ শতাংশ বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে শ্রমিক সংগঠনগুলো দাবি করছে, প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের পোশাক খাতের শ্রমিকদের মজুরি এখনো অত্যন্ত কম। তাদের দাবি, ন্যূনতম মজুরি ২৩ হাজার টাকা এবং প্রতিবছর ১০ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধি করা হোক। শ্রমিক সংগঠনগুলোর এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শ্রম মন্ত্রণালয়ও মজুরিকাঠামো নিয়ে আলোচনার পথে রয়েছে। তবে ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে আরও সহায়ক পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে নতুন মজুরিকাঠামো এবং ঘোষিত ইনক্রিমেন্ট বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে।