‘মৌচাক পুলিশ ফাঁড়ির ১০০ গজের মধ্যে আমার ছেলেটাকে হত্যা করা হলো। হানিফ স্পিনিং মিলের মূল গেটের নিরাপত্তাকর্মীদের সামনে অর্থাৎ এক হাত দূরত্বে ছিনতাইকারীরা ছেলেকে ছুরিকাঘাত করলো, সবার সামনে দিয়ে চলে গেলো তারা, কেউ বাধা দিলো না; শুধুমাত্র ছিনতাইয়ের জন্য। এটা কী করে সম্ভব। ছেলেটা সড়কে পড়ে ছিল সাড়ে চার ঘণ্টা, কেউ উদ্ধার করতে এগিয়ে এলো না। খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে আমি, আমার স্ত্রী ও ছোট ছেলে ঘটনাস্থলে যাই। মৌচাক ফাঁড়িতে খবর দেওয়া হয়। সেখান থেকে বলা হয়েছিল, এটি হাইওয়ে পুলিশের দায়িত্ব। হাইওয়ে পুলিশকে জানানোর পর তারা বলেছে, মৌচাক ফাঁড়ির দায়িত্ব। এমন পরিস্থিতিতে ছেলেটা সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত ঘটনাস্থলে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল। আসলে এসব নিয়ে আমি বাকরুদ্ধ।’
সন্তান হারানোর কষ্টের কথাগুলো শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) বিকালে বাংলা ট্রিবিউনকে এভাবেই বলেছেন ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাজবীর হোসেন শিহানের (২৪) বাবা তানভীর হোসেন নান্নু। ১২ ডিসেম্বর ভোর ৫টার দিকে অফিসে যাওয়ার পথে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের হানিফ স্পিনিং মিলের সামনে হত্যার শিকার হন শিহান। তিনি রাজধানীর উত্তরায় স্কাই টেক সলিউশন কোম্পানিতে জুনিয়র এক্সিকিউটিভ (সেলস) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বাবা-মায়ের সঙ্গে উপজেলার মৌচাক জামতলা মাজার রোড এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। উত্তরার একটি কল সেন্টারে চাকরি করতেন। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তার বাবা বাদী হয়ে কালিয়াকৈর থানায় একটি মামলা করেছেন।
তানভীর হোসেন নান্নু বলেন, ‘সেদিন সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত ঘটনাস্থলে লাশ পড়ে ছিল। এরপর আমার স্ত্রী দায়িত্বশীল একজনকে অনুরোধ করলে লাশ উদ্ধার করেছিল মৌচাক পুলিশ ফাঁড়ি। ছেলের পায়ে ও রানে ধারালো অস্ত্রের কয়েকটি কোপ ছিল। আমার ধারণা দীর্ঘ সময় সেখানে পড়ে থাকায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যায়।’
ছেলের সঙ্গে কারও শত্রুতা ছিল না উল্লেখ করে শিহানের বাবা আরও বলেন, ‘ছেলে পড়াশোনা করেছে ঢাকায়। এলাকায় কেউ বলতে পারবে না কখনও কারও সঙ্গে আড্ডা দিয়েছে। কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিল না। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হানিফ স্পিনিং মিলের মূল গেটের এক নিরাপত্তাকর্মী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, শিহানকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে সকাল ৭টার দিকে আমরা মৌচাক ফাঁড়িতে খবর দিই। সাড়ে ৭টার দিকে পুলিশ সদস্যরা এসে বলেছেন, এটি দেখার দায়িত্ব হাইওয়ে পুলিশের; আমাদের নয়। এই কথা বলে তারা চলে গেছেন। কিন্তু তখন হাইওয়ে পুলিশের কাউকে আমরা পাইনি। ফলে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত ওই শিক্ষার্থী পড়ে ছিল।
শিহানের খালু ওমর ফারুক বলেন, মামলার এজাহারে আমরা উল্লেখ করেছি, হানিফ স্পিনিং মিলের সামনের স্ট্যান্ড পয়েন্ট ঘটনাস্থল। কোন উদ্দেশ্যে এত জনবহুল একটা জায়গায় হত্যা করা হলো, তা তদন্ত করে দেখা দরকার। এটা পুলিশ করবে। পুলিশ যদি তদন্তের আগেই বলে দেয় ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যেই হত্যা, সেটা তো নিরপেক্ষ তদন্ত হলো না। আমরা পুলিশের ওপর আস্থা রাখতে চাই। কারণ, আমাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। কেবলমাত্র হত্যায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি হোক। নিরপরাধ কাউকে যেন ধরা না হয়। হত্যার মোটিভ কী, পরিকল্পনার অংশ কিনা এগুলো পুলিশকে ভালো করে তদন্ত করে দেখতে হবে।
শিহান কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিল না উল্লেখ করে ওমর ফারুক বলেন, গান গাইতো টুকটাক, নিজের মতো করে চাকরি করতো। যখন যেটা মনে হতো দু’একটা ফেসবুকে লিখতো, এই হচ্ছে তার পরিচয়। পরিবারটি মধ্যবিত্ত। মা শিক্ষক, বাবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ৩৫ বছর ধরে এই এলাকায় থাকে তাদের পরিবার। কোনও শত্রু নেই। তবু কেন হত্যা করলো। তাও নির্মমভাবে। শরীরের যেসব জায়গায় আঘাত করেছে, তা মারাত্মক। উরুর ওপরে দুইটা আঘাত দেখেছি। পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া কেবল ছিনতাইয়ের জন্য কাউকে এভাবে হত্যা করা যায় না। এসব বিষয় পুলিশ ভালোভাবে তদন্ত করে দেখবে এটাই আমাদের চাওয়া।
তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জ শহরে ১২ ডিসেম্বর একই সময়ে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (এআইইউবি) শিক্ষার্থী মো. ওয়াজেদ সীমান্ত (২০)। শিহান ও সীমান্ত হত্যা প্রায় একই রকম। দুইটায় ছিনতাইয়ের মতো করে ফ্রেম করা, ফ্রেমিংটা হচ্ছে ছিনতাই, আসলে হত্যা। পুলিশের পাশাপাশি সিআইডি বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য ইউনিট বিষয়টি ভালোভাবে তদন্ত করে দেখতে পারে। এটিকে কেবল ছিনতাইয়ের ঘটনা বলে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। এরকম ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড ছিনতাইকারীদের দিয়ে ঘটানো অসম্ভব।
গত মঙ্গলবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) আমিনুল ইসলাম জানিয়েছেন, তাজবীর হোসেন মৌচাক হানিফ স্পিনিং মিলের সামনে গত বৃহস্পতিবার ভোরে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন। ছিনতাইকারী তাজবীরের হাঁটুতে ছুরিকাঘাত করে তার মোবাইল, স্টুডেন্ট আইডি কার্ড, ব্যাংকের কার্ডসহ মানিব্যাগ ও হাতে থাকা ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। পরে ঘটনাস্থলেই তাজবীরের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় মামলার পর হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের শনাক্ত ও গ্রেফতারে মাঠে নামে পুলিশ। প্রথমে আনোয়ার হোসেন নামের একজন চোরাই মোবাইল কারবারির কাছ থেকে তাজবীরের ফোনটি উদ্ধার করা হয়। পরে আনোয়ার হোসেনকে গ্রেফতার ও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে মূল আসামিদের শনাক্ত করা হয়। এরপর সোমবার রাতে সালনা, কোনাবাড়ী, বাসন ও টঙ্গীতে অভিযান চালিয়ে ছয় জনকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতারকৃতরা হলো- তাকওয়া পরিবহনের চালক ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার আমগাছীহান্দা গ্রামের সরওয়ার হোসেন (২৮), সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার কাশিয়াবাড়ি গ্রামের নাজিম উদ্দিন (৩৫), সিএনজিচালিত অটোরিকশার আরেক চালক কুড়িগ্রামের ওলিপুর থানার মধুপুর গ্রামের সাইফুল ইসলাম (৪২), আজমেরী বাসের চালকের সহকারী লক্ষ্মীপুর সদরের জামেরতলী গ্রামের মো. জুয়েল (২৪), তাকওয়া বাসের কর্মী জয়পুরহাটের মোহনপুর গ্রামের মো. মিলন (২৭) এবং চায়ের দোকানি ভোলার চরফ্যাশন এলাকার আনোয়ার হোসেন (৩৫)।
মৌচাক পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ছিনতাইকারীরা শিহানের হাঁটুতে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করলে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়। তারা পেশাদার ছিনতাইকারী। গত দুই বছর ধরে চন্দ্রা, মৌচাক, কোনাবাড়ী, চান্দনা চৌরাস্তা, টঙ্গী, সালনা এবং শ্রীপুর এলাকায় ছিনতাই করতো বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছে তারা। গত বুধবার গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে পাঁচ জন গাজীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে। এর মধ্যে সরওয়ার হোসেন হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেনি। তাই তার ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। রিমান্ডের শুনানির দিন ধার্য করেননি আদালত।’
যারা গ্রেফতার হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে গাজীপুর কিংবা তাদের এলাকার থানায় ছিনতাই, চুরি, ডাকাতির কোনও মামলা আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ইনচার্জ মহিদুল বলেন, ‘আমাদের সার্ভারে সমস্যার কারণে এখনও মামলার বিষয়গুলো জানা যায়নি। সার্ভার ঠিক হলে তাদের নামে কোনও থানায় এরকম মামলা আছে কিনা, আমরা তা দেখবো।’
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) আমিনুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আসামিরা স্বীকার করেছে শিহানকে ছুরিকাঘাত করার ২০ মিনিট আগে একই এলাকায় কাভার্ডভ্যান চালক মাসুদুর রহমানকে ছুরিকাঘাত করে ছিনতাই করেছিল। শিহানকে হত্যার উদ্দেশ্যে ছিল না তাদের। ছিনতাইকালে শিহান তাদের সঙ্গে ২ থেকে ৩ মিনিট ধস্তাধস্তি করেছে। তাই হাঁটুতে আঘাত করেছে। কিন্তু হাঁটুতে আঘাত করলে শিহানের মৃত্যু হবে এটা ছিনতাইকারীরা বুঝতে পারেনি বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। এরপরও বিষয়টি আরও তদন্ত করে দেখছি আমরা।