স্বাধীন সাংবাদিকতায় বাধা ৩২ আইন

কামাল আহমেদ
ডেস্ক রিপোর্ট
  ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২:৫৮

‘স্বাধীন সাংবাদিকতায় বাধা সৃষ্টি করছে ৩২টি আইন। প্রেস কাউন্সিল একটি ব্যর্থ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠেছে। এটাকে ঠিক করার জন্য আমরা কাজ করছি। একটি সার্ভে করছি যে জনগণ কি আমাদের ওপর আস্থা রাখে কি না, না রাখলে কি করা যেতে পারে আস্থা ফেরানোর জন্য।’ 
রোববার (২২ ডিসেম্বর) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ: গণমাধ্যম প্রসঙ্গ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, গত ৫৩ বছরের মধ্যে এটিই প্রথম সরকারি গণমাধ্যম জরিপ বাংলাদেশজুড়ে। মিডিয়া মালিকানা নিয়ে আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি। গণমাধ্যমের মানুষ যেন তাদের সমস্যার কথা বলতে পারেন ও সমাধান দিতে পারেন, এটি নিয়ে কাজ করছি। কমিশন সাংবাদিকদের বেতন নিয়ে কাজ করতে পারবে না, তবে কমিশন যা করতে পারে যে সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তার কথা উল্লেখ করতে পারে। মিডিয়া নিজেদের সম্পাদকের মূল্যায়ন করে না। এটি করা দরকার নিজের ভুল ধরার জন্য। সেলফ সেন্সরশিপ উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। এটা নিজেকেই তাড়াতে হবে। গণমাধ্যমগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক ও ইউনিয়ন বিভাজন অনেক। এটা নিরসন করতে পারলে অনেক সমস্যাই সমাধান হবে। সংস্কারের মাধ্যমে পরিবর্তন হয় না এমন নয়। এটা নির্ভর করে সরকারের ওপর কতটা চাপ দেওয়া যায় সংস্কার করার জন্য। গত ১৫ বছরের কনটেন্ট আলোচনা করে দেখতে হবে। বাইরের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। এজন্য গণমাধ্যমগুলোর মধ্যে ঐক্য থাকতে হবে যেন তারা বাহ্যিক হস্তক্ষেপ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে। 
‘সাংবাদিকদের জন্য মিনিমাম বেতন থাকতে হবে। সাংবাদিকরা সাংবাদিকতা করবেন, বিজ্ঞাপন না। গত সরকার অনুমতি দিয়েছে যেই ইচ্ছে করবে সেই সাংবাদিকতা করতে পারবেন। এমন কিছু সংবাদ আছে যাদের মিশন কোনো আওয়ামী লীগের আদর্শ প্রচার করা। এই সংবাদমাধ্যম এখনও চালু আছে। টেলিভিশন ও পত্রিকার মালিকানা একই ব্যক্তি বাংলাদেশে বহুল দেখা যায়। এতে একচেটিয়া ব্যবসা তৈরি হয়। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে স্বচ্ছতা থাকতে হবে যে তাদের স্বার্থ কী। এটার নিশ্চয়তা সম্পাদকরা করবেন। বাংলাদেশের সব পত্রিকা ও টেলিভিশন সম্পাদক মিলে আলোচনা করে একটি ভালো সম্পাদকীয় নীতি তৈরি করবেন।’  
গণমাধ্যমে প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে সংবেদনশীলতা নিশ্চিতের আহ্বান 
সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান বলেন, সংস্কার বহুল আলোচিত বিষয়। ১৯৭১ এর পর থেকেই আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিক হওয়ার। কিন্তু আমরা বারবার হোঁচট খেয়েছি। দোষটা আমরা সাধারণত সরকারকে দিয়ে থাকি। কিন্তু তিনি একাই এমন করতে পারে না। তাকে সাহায্য করার অনেক মানুষ থাকে। ১৯৬৯ এর পরে একটা রূপরেখা তৈরি করা হয়। ২০০৭-০৮ এ আবার সংস্কারের কথার উত্থান হয়। কিন্তু তা ঘৃণিত শব্দে পরিণত হয়। ২০২৪ এর পর আবারও সংস্কার বিষয়টি উঠে এসেছে। সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া। গণমাধ্যমের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। একটা সময় বাংলাদেশের গণমাধ্যম খুবই ভালো ছিল, সাংবাদিকরা সাহসিকতার পরিচয় দিতেন। কিন্তু গত কয়েক বছর সাংবাদিকরা অনেক হয়রানির স্বীকার হয়েছেন। গণমাধ্যমকে পাপেট মিডিয়া হিসেবে পরিণত করা হয়েছে। এখন নতুন পরিবেশ তৈরি হয়েছে। কিন্তু রাতারাতি গণমাধ্যমের পরিবর্তন সম্ভব নয়।  

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, সাংবাদিকরা যেন নিজেদের মতো কাজ করতে পারেন। মিডিয়া গত ১৫ বছর জনগণের কথা শোনেনি। যার জন্য বলা হয় কিছু মিডিয়ার হাতে রক্ত আছে। গণমাধ্যম কমিশন করা হয়েছে যেন সাংবাদিকরা তাদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে জানতে পারেন। গণমাধ্যম ব্যর্থ হয়েছে মানবাধিকার রক্ষায়। সাংবাদিকদের সঠিক তথ্য দিতে হবে যেন কারও জীবন নষ্ট না হয়। সাংবাদিকদের যেমন অধিকার আছে তেমন জনগণেরও অধিকার আছে। সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ন্যূনতম বেতন সাংবাদিকদের জন্য নির্ধারণ করে দিতে হবে। সাংবাদিকদের এখানে জোর দিতে হবে। কনটেন্ট চুরি করা বন্ধ করতে হবে। কঠোর কপিরাইট আইন লাগবে। কনটেন্ট নিরাপত্তার জন্য কঠোর আইন লাগবে। কনটেন্ট নিরাপত্তা না থাকার জন্য সাংবাদিকরা বেতন কম পান। ইউনিয়নগুলোকে শক্তিশালী হতে হবে। নতুন বাংলাদেশে নতুন ইউনিয়ন লাগবে, যারা পূর্বাচলের প্লটের পেছনে ছুটবে না। সাংবাদিকদের জন্য যেন কারও মানবাধিকার লঙ্ঘন না হয়, সেদিকা খেয়াল রাখতে হবে।

মানবজমিনের সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, সংস্কার শুনলেই ভয় লাগে। সংবাদপত্রের বন্ধের কাহিনি আগেও হয়েছে। আমি ভীত এমন আবার হয় কি না। বর্তমান সরকার আমাদের লিখতে বললেও আমরা পারছি না। সেলফ সেন্সরশিপ আমাদের কাঁবু করে ফেলেছে। সংস্কার হওয়া উচিত ইতিহাসে। আমাদের দেশে সরকার বদলালে ইতিহাস বদলে যায়। এমন হওয়া যাবে না। লাইসেন্সিংয়ের প্রক্রিয়া আমরা অনেক বড় করে ফেলেছি। পত্রিকার উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা করতে হবে। অ্যাক্রেডিটেশন যেই কমিটি নিয়ে করা হয় তারা সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনা না করে নিজেরা করে। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করতে হবে। 
সাংবাদিক মাহবুব মোর্শেদ বলেন, ছোট সাংবাদিকতার উদ্যোগগুলোর ওপর নজর দিতে হবে। ব্যক্তি সাংবাদিকদের উৎসাহিত করতে হবে। প্রেস কাউন্সিলকে দক্ষ হতে হবে। প্রেস কাউন্সিলকে সিভিল আদালত হিসেবে তৈরি করতে হবে। নতুন যারা এই গণমাধ্যম শিল্পে আসতে চায় তাদের সুযোগ করে দিতে হবে।   
জোনায়েদ সাকি বলেন, অধিকার ও কর্তব্যের মাধ্যমেই একজন নাগরিক হয়ে ওঠে। আমরা অধিকারের দিকেই থাকতে চাই। সাংবাদিকতার কিছু নিয়ম থাকা উচিত যে সে কি করতে পারবে বা করতে পারবে না। নিয়মগুলো মানা হচ্ছে কি না তা প্রেস কাউন্সিল খেয়াল রাখবে। প্রেস কাউন্সিলের বিচারিক ক্ষমতা থাকতে হবে। সাংবাদিকতার স্বাধীনতা থাকতে হবে। বিনিয়োগ থাকবেই। একটা সময় সংবাদ ও বিনিয়োগকারীর মধ্যে দ্বন্দ্ব লাগবেই। এখানে নজর দিতে হবে। সাংবাদিকদের চাকরির নিরাপত্তা দিতে হবে। সংবাদপত্রের মালিকানার পারসেন্টেজ ৫০ পারসেন্টের বেশি থাকবে না। কালো আইন থাকা উচিত নয়। আদালত অবমাননার নামে এখনও অনেক কিছু করা হয় সংবাদমাধ্যমের ওপর। সাংবাদিকরা আদালতের রায় নিয়ে বিতর্ক করতে পারবেন কি না তা নিয়ে পরিষ্কার করে বলতে হবে। 
এ সময় উপস্থিত ছিলেন- গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) চেয়ার মুনিরা খান; সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান, দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী আবু সাইয়িদ, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক মাহবুব মোর্শেদ ও ডিজিটালি রাইট বিডির প্রতিষ্ঠাতা মিরাজ আহমেদ চৌধুরী। 
এছাড়া ঢাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. এস এম শামীম রেজা, এএফপি, ফ্যাক্ট চেক এডিটর কদরুদ্দীন শিশির, দ্য ডেইলি স্টারের সিনিয়র সাংবাদিক জায়মা ইসলাম, সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল, সিনিয়র সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, এনএইচকে টেলিভিশনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি পারভিন এফ চৌধুরী, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এম এ আজিজ ও নাগরিক কমিটির সদস্য তুহিন খান উপস্থিত ছিলেন।