হুমায়ূন আহমেদ। বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক বলা হয় তাকে। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার ও গীতিকার। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের পাঠক তৈরিতে তার জুড়ি মেলা ভার। নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও হুমায়ূন আহমেদ সমাদৃত। নন্দিত এই কথাসাহিত্যিকের ১০ম প্রয়াণ দিবস আজ। বিভিন্ন মাধ্যমে তার অনবদ্য কিছু সৃষ্টি তুলে ধরা হলো_
চলচ্চিত্র
আগুনের পরশমণি : এটি হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র। ১৯৯৪ সালে নির্মিত এ ছবিটি মুক্তি পায় তার পরের বছর। সরকারি অনুদানে নির্মিত ছবিটিতে উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধে অবরুদ্ধ ঢাকার ছোট এক মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প। এতে অভিনয় করেন আসাদুজ্জামান নূর, আবুল হায়াত, বিপাশা হায়াত, ডলি জহুর প্রমুখ। সংগীত পরিচালনা করেন সত্য সাহা। ১ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট ব্যাপ্তির এ ছবিটি সে বছর সেরা ছবি ও সেরা পরিচালকসহ আটটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে।
শ্রাবণ মেঘের দিন : বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নতুন ভাবনা, নতুন মাত্রা যোগ করেছিল ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’। এটি ছিল হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত দ্বিতীয় চলচ্চিত্র। মুক্তি পায় ২০০০ সালে। ছবিটি সাতটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। কুসুম চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেন মেহের আফরোজ শাওন। মতি চরিত্রে জাহিদ হাসান ও সুরুজ চরিত্রে মাহফুজ আহমেদের অভিনয়ও ছিল চমৎকার। ছবিটি একদিকে যেমন ব্যবসাসফল হয়, তেমনি চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের দৃষ্টিতে শিল্পসম্মত হিসেবেও বিবেচিত হয়। নুহাশ চলচ্চিত্রের ব্যানারে নির্মিত হয়েছিল এটি। ছবিতে ময়মনসিংহের লোককবি ও গায়ক উকিল মুন্সীর গান ব্যবহার করেন হুমায়ূন আহমেদ। ‘সোয়াচান পাখি’, ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’ ইত্যাদি গান দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। গানগুলোয় কণ্ঠ দিয়ে খ্যাতি অর্জন করেন বারী সিদ্দিকী।
উপন্যাস
নন্দিত নরকে : হুমায়ূন আহমেদের উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাসটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। প্রকাশের প্রথম দিকে পাঠকদের কাছ থেকে ওইভাবে সাড়া পাননি তিনি। উপন্যাসটি প্রথমে যে প্রচ্ছদে বের হয়েছিল, সে প্রচ্ছদ করেছিলেন লেখকের ভাই ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও ভাস্কর শামীম শিকদার। কিন্তু প্রচ্ছদটি তেমন ভালো হয়নি। নতুন প্রচ্ছদে শোভিত হওয়ার পর ‘নন্দিত নরকে’ নতুন করে আলোচনায় আসে।
জোছনা ও জননীর গল্প : মহান মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য কাহিনিগাঁথা হুমায়ূন আহমেদের এ উপন্যাসটি। গল্প বলার জাদুকর তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতেই বর্ণনা করে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের একেকটা মর্মস্পর্শী কাহিনিকথা। উপন্যাসের শুরুটা নীলগঞ্জ স্কুলের আরবি শিক্ষক ইরতাজুদ্দিন কাশেমপুরীকে দিয়ে। তিনি ঢাকায় এসেছেন তার ভাই শাহেদের সঙ্গে দেখা করতে। শাহেদ ঢাকায় চাকরি করে। ইরতাজুদ্দিন সাহেবের ঢাকায় আসা, শাহেদ আর তার স্ত্রীর মান-অভিমানের পালা যেন একাত্তরের গভীর জীবনবোধেরই পরিচয় বহন করে।
চরিত্র
হিমু : হুমায়ূন আহমেদ সৃষ্ট জনপ্রিয় ও কাল্পনিক চরিত্র হিমু। যে মূলত একজন বেকার যুবক, আর আচরণ কিছুটা অস্বাভাবিক। চাকরির সুযোগ থাকলেও সে চাকরি কখনো করে না বলেই সে বেকার। তার অস্বাভাবিক চরিত্রের মধ্যে সে হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে রাস্তাঘাটে দিন-রাত ঘুরে বেড়ায় এবং মাঝে মাঝে ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে। নব্বইয়ের দশকে হিমুর প্রথম উপন্যাস ‘ময়ূরাক্ষী’ প্রকাশ হয়। প্রাথমিক সাফল্যের পর হিমু চরিত্র বিচ্ছিন্নভাবে হুমায়ূন আহমেদের বিভিন্ন উপন্যাসে প্রকাশ হতে থাকে।
মিসির আলি : চারিত্রিক দিক দিয়ে মিসির আলি চরিত্রটি হিমুর পুরোপুরি বিপরীত। তরুণ হিমু চলে প্রতি-যুক্তির তাড়নায়; অপরপক্ষে বয়োজ্যেষ্ঠ মিসির আলি অনুসরণ করেন বিশুদ্ধ যুক্তি। এ যুক্তিই তাকে রহস্যময় জগতের প্রকৃত স্বরূপ উদ্ঘাটনে সাহায্য করে। সেসব কাহিনির প্রতিফলন ঘটেছে মিসির আলি সম্পর্কিত প্রতিটি উপন্যাসে।
গান
যদি মন কাঁদে : বর্ষা নিয়ে অসংখ্য গান রচনা করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। তেমনি একটি গান ‘যদি মন কাঁদে’। এস আই টুটুলের সুরে এতে কণ্ঠ দিয়েছেন মেহের আফরোজ শাওন। গানটি ব্যবহার হয়েছে বহু নাটকে। সবশেষ গানটি শোনা গেছে ‘কৃষ্ণপক্ষ’ ছবিতে। এটির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১৬-এ শ্রেষ্ঠ গায়িকার পুরস্কার পান শাওন। গানটিতে কণ্ঠ দেওয়ার পাশাপাশি ‘কৃষ্ণপক্ষ’ ছবিটি পরিচালনাও করেন তিনি। এতে অভিনয় করেন রিয়াজ, মাহিয়া মাহিসহ আরও অনেকে।
চাঁদনী পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয় : জোছনা ছিল হুমায়ূন আহমেদের অতিপ্রিয় বিষয়। প্রতি পূর্ণিমাতেই জোছনা দেখতে তিনি নুহাশ পল্লীতে যেতেন, সঙ্গে পুত্র নিষাদ, নিনিত এবং তাদের মমতাময়ী মা। প্রবল জোছনা তার মধ্যে এক ধরনের হাহাকার তৈরি করত। সেই হাহাকারের সন্ধান করে ‘চাঁদনী পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়’ গানটির মধ্য দিয়ে তিনি বিধাতার কাছে ফরিয়াদ জানিয়েছিলেন যেন, জোছনার আলোয় মরণ হয় । শ্রোতা-দর্শকের মাঝে আলোড়ন তোলা এ গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন এস আই টুটুল। পাশাপাশি এর সুরও করেছেন তিনি।