প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের শুরুতে ‘পুলিশ সপ্তাহ’ উদযাপন করে বাংলাদেশ পুলিশ। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতে এবার বছরের শুরুতে হয়নি। শেষমেষ আগামী ২৯ এপ্রিল রাজাররাগ পুলিশ লাইনস অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠিত হবে পুলিশের সর্ববৃহৎ এ অনুষ্ঠান।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করবেন। ওইদিন বিশেষ দরবার অনুষ্ঠিত হওয়ার পর পুলিশ ও রাষ্ট্রপতি পদক পরিয়ে দেবেন তিনি।
প্রতিবার প্যারেডের মাধ্যমে পুলিশ সপ্তাহ উদ্বোধন হলেও এবার তা থাকছে না। এ নিয়ে বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। কমিয়ে আনা হয়েছে অনুষ্ঠানের সময়সীমা ও অনুষ্ঠানসূচিও। পাঁচদিনের পরিবর্তে ২৯, ৩০ এপ্রিল ও ১ মে তিন দিনব্যাপী হবে অনুষ্ঠান।
নাগরিক মতবিনিময়ে গুরুত্ব
পুলিশ সপ্তাহ উদযাপন উপলক্ষে এরই মধ্যে বৈঠক করেছেন নীতিনির্ধারকরা। এরই ধারাবাহিকতায় আরও বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। সূত্র জানায়, প্রথমবারের মতো এবার পুলিশ সপ্তাহে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে বাহিনীর নীতিনির্ধারকদের মতবিনিয়ম সভা হবে। সেখানে উঠে আসা মতামত গুরুত্ব পাবে। কেমন পুলিশ দেখতে চান- এমন বিষয় ওই সভায় উঠে আসবে। ১ মে দুপুরে রাজারবাগ পুলিশ অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হবে নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা।
পুলিশ সপ্তাহ উদযাপনে ইতোমধ্যে বিভিন্ন কমিটি করা হয়েছে। প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। সার্বিক বিবেচনায় এবার পুলিশ সপ্তাহ তিন দিনব্যাপী উদযাপিত হবে। নিরাপত্তা নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই। আমরা আশা করছি সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে একটি সফল পুলিশ সপ্তাহ উদযাপিত হবে।-এআইজি ইনামুল হক সাগর
সূচিতে আসছে বেশকিছু পরিবর্তন
পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, প্রতিবছর সাধারণত পাঁচ-ছয় দিনব্যাপী পুলিশ সপ্তাহ হয়। এবার সেটি কমিয়ে তিন দিনে আনা হয়েছে। কিছু ইভেন্ট কাটছাঁট করে যুক্ত করা হয়েছে নতুন কয়েকটি বিষয়। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তাদের সম্মিলন থাকছে না। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে থাকবে না আলাদা আলোচনার সেশনও। এছাড়া প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়েও পুলিশ সদস্যরা যাচ্ছেন না। প্রধান উপদেষ্টা রাজারবাগ এসে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করবেন। প্রধান বিচারপতির সঙ্গেও নেই কোনো সেশন।
প্রতি বছর পুলিশ সপ্তাহে সরকারপ্রধানের কাছে কনস্টেবল থেকে শুরু করে আইজিপি পর্যন্ত পুলিশ সদস্যরা তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া উত্থাপন করেন। এবারও তেমন দাবি-দাওয়া উত্থাপন করা হবে। তবে সুনির্দিষ্ট কিছু দাবি উত্থাপন করবে পুলিশ। সেগুলো বাস্তবায়নের জন্যও সরকারপ্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে এ বাহিনীর সদস্যরা।
থাকছে না চিরাচরিত প্যারেড
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, পুলিশ সপ্তাহের ইতিহাসে এবারই প্রথম কোনো ধরনের প্যারেড রাখা হয়নি। শিল্ডপ্যারেড প্রতিযোগিতাসহ অন্য প্রতিযোগিতাও নেই আয়োজনে। বিষয়টি নিয়ে অনেক পুলিশ সদস্য ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সাধারণ জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দিতে চায় পুলিশ। নাগরিকের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে একজন মুখ্য আলোচক থাকবেন, পাঁচজন থাকবেন আলোচক। সভায় অর্থনীতিবিদ, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ের নেতারা থাকবেন।
পুলিশের আরেক কর্মকর্তা জানান, দেশের চলমান পরিস্থিতিতে মাঠ পর্যায়ের সদস্যদের অভিজ্ঞতা শোনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পুলিশ সপ্তাহের মতো বড় পরিসরে তা হতে পারে। এতে যেমন নানা সমস্যা উঠে আসবে, তেমনি থাকবে সমাধানে করণীয়।
তিন দিনে পুলিশ সপ্তাহের যত আয়োজন
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, আগামী ২৯ এপ্রিল মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় রাজারবাগ পুলিশ অডিটরিয়ামে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিশেষ দরবার অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান উপদেষ্টা পুলিশের উদ্দেশ্যে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখবেন। এ অনুষ্ঠানে ইউনিটপ্রধানরা ভার্চুয়ালি শুভেচ্ছা জানাবেন প্রধান উপদেষ্টাকে। দুপুর ১টা থেকে দেড়টার মধ্যে দরবার শেষ হবে। এরপর বিকেল সাড়ে ৩টায় আইজিপি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেবেন।
৩০ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টায় পুলিশ অডিটরিয়ামে এসবি, সকাল সোয়া ১০টায় সিআইডি, বেলা ১১টায় র্যাবের প্রেজেন্টেশন হবে। দুপুর ১২টায় পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও স্বরাষ্ট্র সচিবের সম্মেলন হবে। দুপুর আড়াইটা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ট্যুরিস্ট পুলিশ, পিবিআই ও অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের (এটিইউ) প্রেজেন্টেশন হবে। সন্ধ্যা ৭টায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টাদের সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
১ মে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বেলা পৌনে ১২টা পর্যন্ত এপিবিএন, রেলওয়ে পুলিশ ও নৌ পুলিশের প্রেজেন্টেশন থাকবে। এরই মধ্যে সকাল ১০টায় পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতির স্টল পরিদর্শন ও বার্ষিক পুনাক সমাবেশ হবে। দুপুর ১২টায় হবে বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে পুলিশের মতবিনিময় সভা। বিকেল ৩টায় শিল্পাঞ্চল পুলিশের প্রেজেন্টেশন হবে। বিকেল পৌনে ৪টায় পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক সাধারণ সভা, সন্ধ্যা ৭টায় অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে বর্তমান পুলিশ কর্মকর্তাদের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান এবং রাতে ডিনারের মাধ্যমে পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠান শেষ হবে বলে জানা যায়।
গণহারে দেওয়া হবে না পুলিশ পদক
পুলিশের একটি সূত্রে জানা যায়, এবার গণহারে পুলিশ পদক না দেওয়ার বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ সদরদপ্তর। এ নিয়ে আইজিপিসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। পুলিশের মনোগ্রাম থেকে নৌকা বাতিল, স্বাধীনভাবে কাজের সুযোগ, স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন, যানবাহন ও আবাসন সংকট সমাধান, নির্দিষ্ট সময় ডিউটির বাইরে অতিরিক্ত কাজের জন্য ভাতা এবং থানায় পুলিশের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ বন্ধ করা, অবসরে যাওয়ার পর পরিবারের সদস্য অনুযায়ী রেশন পাওয়াসহ বিভিন্ন যৌক্তিক দাবি উত্থাপন করা হবে।
ডিআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা জানান, এবারের পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানে কাটছাঁট হলেও তাৎপর্যতা রয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে পারে। বৈঠকে এ নির্বাচনের বিষয়ে দিকনির্দেশনা আসবে। পুলিশ বাহিনী রাজনৈতিক প্রভাবের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে বিভিন্ন দাবি-দাওয়াও উপস্থাপন করবে।
জানতে চাইলে পুলিশ সদরদপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘পুলিশ সপ্তাহ উদযাপনে ইতোমধ্যে বিভিন্ন কমিটি করা হয়েছে। প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। সার্বিক বিবেচনায় এবার পুলিশ সপ্তাহ তিন দিনব্যাপী উদযাপিত হবে। নিরাপত্তা নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই। আমরা আশা করছি সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে একটি সফল পুলিশ সপ্তাহ উদযাপিত হবে।’