বিনিয়োগ সম্মেলন-২০২৫

৩১০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ কি হঠাৎ নাকি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ফল?

ডেস্ক রিপোর্ট
  ১৫ এপ্রিল ২০২৫, ২০:০৪

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) আয়োজনে চারদিনব্যাপী (৭ এপ্রিল থেকে ১০ এপ্রিল) বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলন-২০২৫ সম্প্রতি শেষ হয়েছে। সম্মেলন শেষ হওয়ার পর কয়েকদিন পেরিয়ে গেলেও সম্মেলন থেকে প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি তথা সার্বিক আয়োজন নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ ও আলোচনার রেশ রয়ে গেছে এখনও।
চার দিনব্যাপী এ সম্মেলনে সরকারের মাত্র দেড় কোটি টাকা খরচে দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে (হান্দা ইন্ডাস্ট্রিজ ও শপআপ) তিন হাজার ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের ঘোষণা এসেছে। আয়োজনের বাকি অর্থ এসেছে স্পন্সর প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে। এর বাইরে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে ছয়টি।
প্রশ্ন উঠেছে, সম্মেলন থেকে দুটি প্রতিষ্ঠানের সর্বমোট তিন হাজার ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের ঘোষণা কি তাৎক্ষণিক নাকি সম্মেলনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ফসল?

এক নজরে সম্মেলনের চিত্র
সম্মেলনে ৫০ দেশের ৪১৫ বিদেশি ও প্রবাসী বাংলাদেশি অংশ নেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নেন ৭১০ জন বিনিয়োগকারী। তাদের মধ্যে ৪১৫ জন বিদেশি ও প্রবাসী বাংলাদেশি ও অবশিষ্ট ৩৯৫ ছিলেন বাংলাদেশি। শতকরা হিসাবে বিদেশি বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ছিল ৫৮ শতাংশ। এর বাইরে চারদিনে বিভিন্ন ইভেন্ট সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি মানুষ অংশ নেন।
সম্মেলনে প্যানেলিস্ট ও স্পিকার হিসেবে ছিলেন ১৩০ জন। এই সম্মেলনে সরকারিভাবে ১৫০টি বৈঠক হয়। বৈঠকে বাণিজ্য উপদেষ্টা, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলন সফল করতে বিশ্বব্যাংক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউএনডিপি, এইচএসবিসি ব্যাংক, বিজিএমইএ, সাজিদা ফাউন্ডেশন এবং ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা সহায়তা করেছে।
‘কোনো বিনিয়োগকারীই আবেগপ্রবণ হয়ে ১০০ কোটি টাকার চেক লিখে ফেলে না’
বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলন-২০২৫ এর মূল আয়োজক সংস্থা বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, যে ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকার ঘোষণা এসেছে তার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব এ সম্মেলনকে দেওয়া উচিত হবে না। এর আগে অনেক কাজ করে দুটি কোম্পানির কাছ থেকে বিনিয়োগের এ ঘোষণা আনা হয়েছে।
তিনি বলেন, পৃথিবীর কোনো মানুষ, কোনো বিনিয়োগকারীই এরকম সম্মেলনে এসে আবেগপ্রবণ হয়ে ১০০ কোটি টাকার চেক লিখে ফেলেন না। ফলে সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে বলেই তিন হাজার ১০০ কোটি টাকার বিনিয়োগের ঘোষণা এসেছে, তা মনে করা ঠিক হবে না।

সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য যা ছিল
আশিক চৌধুরী বলেন, সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে পারসেপশন সেটাকে পরিবর্তন করা। বিদেশিরা যখন বাংলাদেশে স্বশরীরে একবার আসে এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে যে ধারণা নিয়ে ফিরে যান সেটা কিন্তু গুগল সার্চ করে পান না। এবারের সম্মেলনে যেসব বিদেশি বিনিয়োগকারী অংশ নিয়েছেন, তারা বাংলাদেশ থেকে ইতিবাচক ধারণা নিয়ে ফিরে যাবেন এবং তারা তাদের পরিচিত বন্ধুবান্ধব ও বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক কথাবার্তা বলবেন।
তিনি বলেন, সম্মেলনের প্রথম দুদিন (৭ ও ৮ এপ্রিল) আমরা তাদেরকে বাংলাদেশ ঘুরিয়ে দেখিয়েছি। বিভিন্ন ফ্যাক্টরি ঘুরিয়ে দেখিয়ে বাংলাদেশে ফ্যাক্টরি করতে হলে কোন জায়গায় করতে হবে, জায়গাটা দেখতে কেমন এসব কথা বলেছি। ৯ এপ্রিল সকালে আমরা আমাদের ভিশন দেখিয়েছি যে, আমরা কোথায় আছি এবং কোথায় যেতে চাই । একদিন বিকেলে এবং পরদিন আমরা তাদের বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে ওয়ান টু ওয়ান বৈঠকে কথা বলেছি।
আশিক চৌধুরী গণমাধ্যম কর্মীদের জানান, আমরা প্রবাসীদের বাংলাদেশ সম্পর্কে যে ৩৬০ ডিগ্রি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছি তাতে তারা সন্তুষ্ট বলে জানিয়েছেন। তারা অনেক তথ্য ও প্রাপ্তি নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন।
উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করেছি বাংলাদেশ প্রথমেই যেন মেনু থেকে বাদ না পড়ে যায়, অর্ডার তো পরের কথা। ইতোপূর্বে আলোচনা শুরুর আগেই মেনু থেকে বাদ পড়ে যেত বাংলাদেশ।
সম্মেলনের সফলতা-ব্যর্থতা বোঝা যাবে দুই বছর পর
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, এ সম্মেলনের মাধ্যমে বিনিয়োগের একটি পাইপলাইন তৈরি হয়েছে, যার সুফল পাওয়া যাবে ২০২৬ কিংবা ২৭ সালে। ওই সময় জিডিপি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়লে বুঝতে হবে ২০২৫ সালের বিনিয়োগ সম্মেলনটি সফল ছিল।
তার মতে, বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত শুধু সম্মেলনকে কেন্দ্র করে হয় না। সম্মেলনের পর বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষার পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এছাড়া মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ অনেক কিছুর ওপর বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নির্ভর করে। সুতরাং দুই বছর পর জিডিপি বাড়লে এর কৃতিত্ব পুরোপুরি বিডা ও বেপজার নেওয়া উচিত হবে না। তেমনি বিনিয়োগ বৃদ্ধি তথা জিডিপি না বাড়লে এর পুরো দায়ও বিডা ও বেপজার ওপর দেওয়া ঠিক হবে না। একটা বিনিয়োগ সফল করতে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা থাকে। সবগুলো ভূমিকা সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ঠিকমতো পালন করতে পারলে তখনই বিনিয়োগ নিশ্চিত হয়।

বিনিয়োগকারীদেরকে রাজনৈতিক দলগুলোর আশ্বাস
আশিক চৌধুরী বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর অন্যতম এজেন্ডাই থাকে দেশে বিনিয়োগ বাড়ানো ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। এ কারণে দেশের তিনটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি- এ তিনটি রাজনৈতিক দলকে বিনিয়োগ সম্মেলনে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। সম্মেলনে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কতটুকু থাকবে তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন বিনিয়োগকারীদের। রাজনৈতিক দলগুলো সম্মেলনে আসা বিনিয়োগকারীদের সব ধরনের সহযোগিতা নিশ্চিতের ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানীর ঘাটতি মেটাবে প্রাণ-আরএফএল:
এবারের সম্মেলনে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি প্রাণ-আরএফএল এর সঙ্গে এইচঅ্যান্ডএম কোম্পানির নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের ব্যাপারে চুক্তি হয়েছে। বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ঘাটতি রয়েছে। এ ঘাটতি মেটানোর জন্য তাৎক্ষণিকভাবে এই চুক্তি করা হয়।
আশিক চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে সশরীরে না এসে বাংলাদেশ সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা লাভ করা সম্ভব নয়। কারণ বাংলাদেশকে মোটা দাগে জনসংখ্যার অধিক ঘনত্ব ও বন্যা এবং দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসেবে দেখানো হয়।
বিনিয়োগ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিনিয়োগকারীরা বলেছেন, তাদের যেমন আমন্ত্রণ করে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়েছে, তাদের পরিচিত বন্ধু ও অন্যান্য বিনিয়োগকারীদেরও যেন সেভাবেই বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। এ সম্মেলনে যারা আগ্রহ দেখিয়ে রেজিস্ট্রেশন করেছিল তাদের প্রত্যেকের ইমেইলসহ বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। সম্মেলন শেষে তাদের ধন্যবাদ পত্র পাঠানোর মাধ্যমে ফলোআপ কার্যক্রম শুরু হবে। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার মাধ্যমে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা হবে।
আশিক চৌধুরী বলেন, বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ইজ সায়েন্স। এটা কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডে সবারই জানা ও বহুল প্রয়োগযোগ্য।এবারের বিনিয়োগ সম্মেলনে যারা প্রথমবারের মতো এসেছেন তাদের মধ্যে যদি ভবিষ্যতে একজনও ১০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে তাতেই কিন্তু সম্মেলনের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যাবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি দশে দশ পাওয়ার মতো বিনিয়োগ সম্মেলন হয়নি। সম্মেলনে আরও অনেক কিছু করার সুযোগ আছে। আমরা আসলে এ বিনিয়োগ সম্মেলনে আমরা একটা স্ট্যান্ডার্ড সেট করার চেষ্টা করেছি।