আদালতে মামলার জটে ক্লান্ত বাদী-বিবাদী

ডেস্ক রিপোর্ট
  ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ২১:১৭

ময়মনসিংহের আদালতগুলোতে মামলাজট সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন মামলার বিচারকার্য দেরিতে শেষ হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন বাদী-বিবাদীরা। মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেকে মামলা চালানো থেকে সরে আসছেন। পাশাপাশি মামলা চালাতে গিয়ে উকিলের খরচসহ আদালতে দৌড়ঝাঁপেও ক্লান্ত অনেকে। এমতাবস্থায় মামলার দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে আনার দাবি সবার। তবে এতে সরকারি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আদালত সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন আদালতে (জেলা ও দায়রা জজ ও অধস্তন) বিভিন্ন ধরনের দেওয়ানি ও ফৌজদারি ৫ হাজার ৮৫৯টি মামলা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে ময়মনসিংহ চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের আমলি ও বিচারিক আদালতে ফৌজদারি মামলা হয়েছে ৬ হাজার ২৬৮টি। বর্তমানে ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন আদালতে (জেলা ও দায়রা জজ ও অধস্তন) বিভিন্ন ধরনের দেওয়ানি ও ফৌজদারি ৭৩ হাজার ২৫৮টি মামলা বিচারাধীন। এছাড়া ময়মনসিংহ চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আমলি ও বিচারিক আদালতে আরও ৫৩ হাজার ৫০১টি ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন। এ হিসাবে মোট ১ লাখ ২৬ হাজার ৭৫৯টি মামলা আদালতগুলোতে বিচারাধীন।
আমার বাসা ভালুকায়। গত বছরের ৫ নভেম্বর একটি মামলায় আমি, আমার স্বামী, আমার বোন ও বোনজামাইকে আসামি করা হয়েছে। আমি ও আমার বোনজামাই তিন মাস আগে জামিনে মুক্ত হয়েছি। বাকি দুজনের জামিন পেতে উকিল ধরেছি। এ পর্যন্ত মামলা বাবদ চার লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়েছে। অপরাধ প্রমাণিত হলে দ্রুত শাস্তি ও অপরাধ প্রমাণিত না হলে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করার দাবি জানাচ্ছি।- শরীফা খাতুন
গত রোববার (২০ এপ্রিল) সরেজমিনে জেলা ও দায়রা জজ প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা যায়, বাদীসহ আসামিদের পরিবারের লোকজন ও স্বজনরা বারান্দাসহ ফটকের আশপাশে অবস্থান করছেন। আসামির জামিন পেতে মনমতো উকিল রাখা হয়েছে। এসময় একটি পাঁচ বছর ও একটি দেড় বছরের শিশুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় শরীফা খাতুন নামের এক নারীকে। তার সঙ্গে দাঁড়িয়েছিলেন বোনজামাই। এসময় কথা হয় শরীফা খাতুনের সঙ্গে।
তিনি বলেন, আমার বাসা ভালুকায়। গত বছরের ৫ নভেম্বর একটি মামলায় আমি, আমার স্বামী, আমার বোন ও বোনজামাইকে আসামি করা হয়েছে। আমি ও আমার বোনজামাই তিন মাস আগে জামিনে মুক্ত হয়েছি। বাকি দুজনের জামিন পেতে উকিল ধরেছি। এ পর্যন্ত মামলা বাবদ চার লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়েছে। অপরাধ প্রমাণিত হলে দ্রুত শাস্তি ও অপরাধ প্রমাণিত না হলে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করার দাবি জানাচ্ছি। এক্ষেত্রে আদালতে পুলিশের দ্রুত চার্জশিট দাখিল করা উচিত। কারণ, সময় বেশি লাগলে ভোগান্তিও সমানতালে বাড়ে।
জমি সংক্রান্ত একটি মামলা সংশ্লিষ্ট আদালতে চলমান। কয়েক বছর অতিবাহিত হলেও মামলা তেমন গতি পায়নি। আমি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। শুনানির দিন ছুটি না পাওয়ায় আসতে পারি না। মনে হচ্ছে আমার ত্রুটির কারণেই রায় আমার বিরুদ্ধে যাবে।- হান্নান
হান্নান নামের আরেকজন বলেন, জমি সংক্রান্ত একটি মামলা সংশ্লিষ্ট আদালতে চলমান। মামলা দায়েরের কয়েক বছর অতিবাহিত হলেও মামলা তেমন গতি পায়নি। আমি একটি বেসরকারি চাকরি করি। শুনানির দিন ছুটি না পাওয়ায় আসতে পারি না। মনে হচ্ছে, আমার ত্রুটির কারণেই রায় আমার বিরুদ্ধে যাবে।
জেলার তারাকান্দা উপজেলার রফিকুল ইসলাম বলেন, ময়মনসিংহ সদরের রাঘবপুর এলাকায় আমার বোনের বাড়ি। বোনের স্বামী অন্য নারীর সঙ্গে পরকীয়ায় লিপ্ত ছিল। তারা গোপনে বিয়েও করে। এটি আমার বোন জানতে পারায় সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে রাতে পরিকল্পিতভাবে আমার বোনকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় তিন বছর আগে আদালতে মামলা করেছি। অপরাধীর বিচার নিজ চোখে দেখে শান্তি পেতে এখনো মামলা চালিয়ে যাচ্ছি। দ্রুত সময়ে মামলা নিষ্পত্তি হলে ভোগান্তি কমে যেত।
ময়মনসিংহের প্রত্যেক আদালতে বিচারক রয়েছে। তবুও মামলাজট তীব্র আকার ধারণ করেছে। প্রচুর মামলার কারণে বিচারকদের অনেক সময় দিতে হচ্ছে। মামলাজট কমাতে হলে বিচারকের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। তাহলে মামলাজট কমবে, মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে।
ময়মনসিংহ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর সঞ্জীব সরকার সঞ্জু বলেন, একেকটা আদালতে প্রচুর মামলা। এজন্য বিচারকদের সারাদিনই আদালতে সময় দিতে হয়। মামলা অতিরিক্ত থাকার কারণে শুনানির তারিখ তিন-চার মাস পর দিতে হয়। বারবার বলা সত্ত্বেও সাক্ষী আসে না। আসামিপক্ষ বারবার সময়ের আবেদন করে। কোনো কোনো মামলার সাত-আটজন সাক্ষী এলেই বিচারকের দু-এক ঘণ্টা সময় চলে যায়।
তিনি বলেন, ময়মনসিংহের প্রত্যেক আদালতে বিচারক রয়েছে। তবুও মামলাজট তীব্র আকার ধারণ করেছে। প্রচুর মামলার কারণে বিচারকদের অনেক সময় দিতে হচ্ছে। মামলাজট কমাতে হলে বিচারকের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। তাহলে মামলাজট কমবে, মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. নুরুল হক বলেন, বিচারক বাড়ানোর পাশাপাশি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। কারণ, কয়েকজনের কাজ একজনকে করতে গিয়ে সময়ক্ষেপণ হয়। মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেকে ভোগান্তির কথা চিন্তা করে অপরাধীর বিরুদ্ধে মামলা করতে সাহস পায় না। আমরাও চাই, মামলাজট কমুক, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মামলা নিষ্পত্তি হোক।