আট মাসে দুই ডজন নতুন দলের আত্মপ্রকাশ

চলছে নতুন দলের মহাউৎসব, অপেক্ষায় আছে আরও অনেক
ডেস্ক রিপোর্ট
  ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৩৮

দেশে একের পর এক রাজনৈতিক দল আসছে। গণ-অভ্যুত্থানের পর গত ৮ মাসে দুই ডজন নতুন দলের আত্মপ্রকাশ হয়েছে। চলছে নতুন রাজনৈতিক দলের মহাউৎসব। পাইপলাইনে আছে আরও অনেক। সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন ও সাংবাদিক শওকত মাহমুদের নেতৃত্বে ‘জনতা পার্টি, বাংলাদেশ’ নামে একটি দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। আজ শনিবার এই তালিকায় যুক্ত হতে যাচ্ছে আরেকটি দল। এই দলের নাম ঠিক করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ নতুনধারা জনতার পার্টি’। এ ছাড়া সামনে আরও দল আসতে পারে বলে গুঞ্জন রয়েছে।
নতুন দলগুলোর মধ্যে কেবল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) মূলধারার রাজনীতিতে আলোচিত দল। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী তরুণদের গড়া এই দলের আত্মপ্রকাশ দেশের রাজনীতিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
চলতি বছরের চার মাস শেষ হওয়ার আগেই আরও ১২টি নতুন রাজনৈতিক দল এসেছে। এর মধ্যে গত ২৮ জানুয়ারি এক দিনেই দুটি দলের আবির্ভাব ঘটে।
গত বছরের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর—এই ৫ মাসে ১১টি দল আত্মপ্রকাশ করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দল এসেছে সেপ্টেম্বরে। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে নিউক্লিয়াস পার্টি অব বাংলাদেশ (এনপিবি) নামের একটি রাজনৈতিক দলের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে গত বছরের ২৩ আগস্ট দলটির ঘোষণা দেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লিডারশিপ ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির উপদেষ্টা অধ্যাপক মোহাম্মদ সিদ্দিক হোসাইন ও এস এম ডি জিদানের যৌথ উদ্যোগে দলটি গঠিত হয়েছে।
এরপর ৮ সেপ্টেম্বর জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক পার্টি, ১৯ সেপ্টেম্বর ওয়ার্ল্ড মুসলিম কমিউনিটি, ২০ সেপ্টেম্বর সমতা পার্টি, ২৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জনপ্রিয় পার্টি (বিপিপি), ২৭ সেপ্টেম্বর সার্বভৌমত্ব আন্দোলন, ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশ সংস্কারবাদী পার্টি (বিআরপি), ১৬ নভেম্বর বাংলাদেশ মুক্তির ডাক ৭১, ২৮ নভেম্বর বাংলাদেশ জাগ্রত পার্টি, ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পার্টি (বিজিপি) ও ১৬ ডিসেম্বর জাতীয় বিপ্লবী পরিষদের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
ফেব্রুয়ারিতে আত্মপ্রকাশ করে তিনটি দল—বাংলাদেশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিএসডিপি), বাংলাদেশ জন-অধিকার পার্টি ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
চলতি বছরের চার মাস শেষ হওয়ার আগেই আরও ১২টি নতুন রাজনৈতিক দল এসেছে। এর মধ্যে গত ২৮ জানুয়ারি এক দিনেই দুটি দলের আবির্ভাব ঘটে। দল দুটি হলো আমজনতার দল ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক শক্তি। এর আগে ৪ জানুয়ারি আত্মপ্রকাশ করে দেশ জনতা পার্টি।
ফেব্রুয়ারিতে আত্মপ্রকাশ করে তিনটি দল—বাংলাদেশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিএসডিপি), বাংলাদেশ জন-অধিকার পার্টি ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
মার্চে জন্ম জনতার বাংলাদেশ পার্টি ও জনতার দলের। চলতি মাসে সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক দলের ঘোষণা আসে। ১১ এপ্রিল গণতান্ত্রিক নাগরিক শক্তি, ১৩ এপ্রিল ভাসানী জনশক্তি পার্টি, ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ আ-আম জনতা পার্টি (বিএজেপি) এবং গতকাল (২৫ এপ্রিল) জনতা পার্টি বাংলাদেশ প্রকাশ্যে আসে। আজ শনিবার আরেকটি দলের নাম ঘোষণা হতে যাচ্ছে।
তিনি বিএনপি থেকে জাতীয় পার্টি, সেখান থেকে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দলে (পিডিপি) যোগ দিয়েছিলেন। নতুন দলে আসার আগে সর্বশেষ বিকল্পধারায় ছিলেন।
সর্বশেষ শুক্রবার সকালে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আত্মপ্রকাশ ঘটে জনতা পার্টি বাংলাদেশ-এর। দীর্ঘদিন নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের (নিসচা) নেতা ইলিয়াস কাঞ্চন নতুন এই দলের চেয়ারম্যান। আর মহাসচিব হলেন সাংবাদিক নেতা ও বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদ। দলীয় ‘শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজে’ লিপ্ত থাকার অভিযোগে ২০২৩ সালের ২১ মার্চ তাঁকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়। দলটির নির্বাহী চেয়ারম্যান ও মুখপাত্র হয়েছেন গোলাম সারোয়ার মিলন। তিনি বিএনপি থেকে জাতীয় পার্টি, সেখান থেকে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দলে (পিডিপি) যোগ দিয়েছিলেন। নতুন দলে আসার আগে সর্বশেষ বিকল্পধারায় ছিলেন।
এদিকে নতুন এই দলের ঘোষণার আগের দিন ইলিয়াস কাঞ্চনকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন শফিকুল ইসলাম সবুজ খান নামের এক ব্যক্তি। ‘জনতার বাংলাদেশ পার্টি’ নামে তাঁর একটি দল রয়েছে। কাছাকাছি নাম রাখায় তিনি আইনি নোটিশ পাঠান। তবে এই নিয়ে সমস্যা দেখছেন না জনতা পার্টি বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন।
জনপ্রিয় পার্টি, জাগ্রত পার্টি, আ-আম জনতা পার্টিসহ বেশ কয়েকটি দলের নাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এর মধ্যে ১৭ এপ্রিল আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ আ-আম জনতা পার্টি, যার প্রধান ডেসটিনির মোহাম্মদ রফিকুল আমীন।
আজ শনিবার আত্মপ্রকাশ ঘটতে যাচ্ছে ‘বাংলাদেশ নতুনধারা জনতার পার্টি’র। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দলটির উদ্যোক্তা হিসেবে বেশ কয়েকজনের নাম লেখা রয়েছে। তাঁরা হলেন এ টি এম মমতাজুল করিম, মুহাম্মাদ আবদুল আহাদ নূর, রেজাউল হক, ইশারুল হোসেন, মিজানুর রহমান, মো. ওসমান গনী প্রমুখ।
জনপ্রিয় পার্টি, জাগ্রত পার্টি, আ-আম জনতা পার্টিসহ বেশ কয়েকটি দলের নাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এর মধ্যে ১৭ এপ্রিল আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ আ-আম জনতা পার্টি, যার প্রধান ডেসটিনির মোহাম্মদ রফিকুল আমীন। ১২ বছর কারাভোগের পর গত ১৫ জানুয়ারি জেল থেকে বের হন এবং তিন মাসের মাথায় নতুন রাজনৈতিক দল নিয়ে হাজির হন তিনি।
দল ঘোষণার দিন তাঁর কাছে সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল, হঠাৎ রাজনীতিতে কেন নাম লেখালেন? জবাবে রফিকুল আমীন বলেন, ‘বহু লোককে বিগত স্বৈরাচারী সরকারের সময়ে ফাঁসি, যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়েছিল, এখন তাঁরা রাজনৈতিক কারণে মুক্ত। আমি রাজনীতি করতাম না, তাই আমাকে রিলিজ (মুক্তি) দেওয়া হয়নি। আমার রাজনীতিতে আসার এটাও একটা কারণ।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিগত সময়গুলোতেও রাজনৈতিক দল গঠনের প্রতিযোগিতা দেখা গিয়েছিল। ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পেতে ৯৩টি আবেদন জমা পড়ে নির্বাচন কমিশনে (ইসি)।
বহু লোককে বিগত স্বৈরাচারী সরকারের সময়ে ফাঁসি, যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়েছিল, এখন তাঁরা রাজনৈতিক কারণে মুক্ত। আমি রাজনীতি করতাম না, তাই আমাকে রিলিজ (মুক্তি) দেওয়া হয়নি। আমার রাজনীতিতে আসার এটাও একটা কারণ।
এবারও এখন পর্যন্ত ৬৫টি দল নিবন্ধনের জন্য ইসিতে আবেদন করেছে। এর মধ্যে অনেকগুলো দলের নাম গতানুগতিক রাজনৈতিক দলের নামগুলো থেকে অনেকটাই আলাদা। যেমন ‘বাংলাদেশ সংস্কারবাদী পার্টি’, ‘বাংলাদেশ শান্তির দল’, ‘দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও আন্দোলন’, ‘জাতীয় ভূমিহীন পার্টি’, ‘বাংলাদেশ বেকার সমাজ’, ‘বাংলাদেশ জনপ্রিয় পার্টি’, ‘জনতার কথা বলে’।
ইসি সূত্র জানায়, এখন ইসিতে নিবন্ধিত দল আছে ৫০টি। আরও ৪৬টি দল নিবন্ধনের আবেদন জমা দেওয়ার সময় বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে। এই দলগুলোর বেশির ভাগই নামসর্বস্ব। তাদের কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ে না। ইসি নিবন্ধনের সময় বাড়ানোয় ধারণা করাই যায়, নিবন্ধন পেতে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা আরও বাড়বে।
ছাত্ররা (জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা তরুণেরা) ভালো-মন্দ যা-ই হোক, একটি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ পর্যায়ে এসেছে। সেদিক থেকে তাদের একটা কিছু করার যৌক্তিকতা ছিল।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখেই এসব দলের উৎপত্তি বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। তাঁদের মতে, নির্বাচন এগিয়ে এলে এ ধরনের দল গঠনের তোড়জোড় দেখা যায়। একই সঙ্গে এর পেছনে থাকে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের হীন উদ্দেশ্যও।
এত এত রাজনৈতিক দল গঠনের পেছনে ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ্‌। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্ররা (জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা তরুণেরা) ভালো-মন্দ যা-ই হোক, একটি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ পর্যায়ে এসেছে। সেদিক থেকে তাদের একটা কিছু করার যৌক্তিকতা ছিল। কিন্তু এখন যেসব রাজনৈতিক দল আসছে, সেগুলো রাজনৈতিকভাবে বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্যই আসছে। এসবের নেপথ্যে কোনো মহলের জল ঘোলার প্রয়াসও থাকতে পারে বলেও মনে করেন অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ্।