আলটিমেটামের সময় পার

সোমবার শপথ না পড়ালে ‘গেজেট বাতিল’

ফের আদালতে দৌড়ঝাঁপ ইশরাকের
ডেস্ক রিপোর্ট
  ২৫ মে ২০২৫, ২৩:৫২

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র পদে শপথ পড়াতে সরকারকে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা সময় দিয়েছিলেন বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন। বৃহস্পতিবার (২২ মে) ওই সময় দিয়ে কাকরাইল মোড়ে আন্দোলন স্থগিত করেন তিনি। রোববার (২৫ মে) সন্ধ্যা পর্যন্ত ৭২ ঘণ্টার বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এখনো তাকে শপথ পড়ানো হয়নি।

এমন পরিস্থিতিতে ডিএসসিসি মেয়র হিসেবে শপথ পড়াতে উচ্চ আদালতে রোববার (২৫ মে) রিট করেন ইশরাক হোসেন। কিন্তু তার রিটের বিষয়ে আদালত থেকে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। বৃহস্পতিবার (২২ মে) মেয়র হিসেবে ইশরাক হোসেনকে শপথ পড়াতে কোনো বাধা নেই বলে আদালত যে রায় দিয়েছিলেন, ওই রায়ের বিরুদ্ধে রোববার আপিল করেন রিটকারীর আইনজীবী। সোমবার (২৬ মে) ওই আপিলের শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। এদিন শপথ না পড়ানো হলে বাতিল হয়ে যেতে পারে গেজেট। ইশরাকের সমর্থকরা এখনো অচল করে রেখেছেন নগর ভবন।

সোমবার শপথ না পড়ালে গেজেট বাতিল
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ওই আপিল শুনানিতে ইশরাকের পক্ষে রায় গেলেও তার শপথ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কারণ, ইশরাককে ডিএসসিসির মেয়র ঘোষণা করে গত ২৭ এপ্রিল গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ওই চিঠির ৩০ দিনের মধ্যে শপথ পড়ানো বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাই সোমবারের (২৬ মে) মধ্যে শপথ পড়ানো না হলে ওই গেজেট বাতিল হতে পারে। তখন ইশরাক হোসেনকে শপথ পড়াতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বাধ্য থাকবে না।
এ বিষয়ে রিটকারীর আইনজীবী মুহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘ইসির গেজেটে ৩০ দিনের মধ্যে শপথ পড়াতে বলা হয়েছে। এ হিসেবে আগামীকাল সোমবারের মধ্যে শপথ পড়ানোর কথা। কিন্তু আইনগত জটিলতায় শপথ না পড়ানো হলে করণীয় কী হবে তা আইনে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই।’

এমন অবস্থায় ইশরাক হোসেনের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ইশরাক বলেন, ‘যেহেতু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ‘সিটি করপোরেশন আইন’ অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শপথ পড়ানোর কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান হয়নি, তাই কোর্টের দ্বারস্থ হওয়ার বিষয়ে আমরা আলোচনা করছি। তবে এখন পর্যন্ত রিট পিটিশন দায়ের অথবা চূড়ান্ত করা হয়নি। আদালতের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আমরা একটি এন্ট্রি করিয়েছি। পরবর্তী কার্যক্রম বা কর্মসূচি সময়মতো গণমাধ্যমকে জানানো হবে।’
২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়। আওয়ামী লীগের প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র নির্বাচিত হন। একই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি ভোটের ফলের গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। শপথ নিয়ে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন তাপস। তখন নির্বাচনে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ফলাফল বাতিল চেয়ে ২০২০ সালের ৩ মার্চ মামলা করেন বিএনপি নেতা ইশরাক।
গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। একই বছরের ১৯ আগস্ট ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনসহ সিটি করপোরেশনের মেয়রদের অপসারণ করা হয়। এর মধ্যে ইশরাকের করা নির্বাচনী মামলায় চলতি বছরের ২৭ মার্চ রায় দেন ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল। রায়ে ইশরাককে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা করা হয়।
ওই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ইশরাককে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা করে গত ২৭ এপ্রিল গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। মেয়র হিসেবে ইশরাকের শপথের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন কমিশন থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়। চিঠির পরও কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় গত ১৪ মে থেকে নগর ভবনে তালা ঝুলিয়ে ইশরাকের সমর্থকরা বিক্ষোভ শুরু করেন। এতে নগর ভবনের প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। নগর ভবনে থাকা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়েও উপদেষ্টাসহ কেউ ঢুকতে পারেনি।

এর মধ্যে ইশরাক হোসেনকে যাতে শপথ না পড়ানো হয়, এ নিয়ে উচ্চ আদালতে রিট করেন এক ব্যক্তি। গত বুধবার (২১ মে) ওই রিটের শুনানি হয়। শুনানির আগেই উচ্চ আদালত, মৎস্য ভবন, কাকরাইল মসজিদের সামনের সড়ক অবরোধ করে অবস্থান নেন তারা। ওইদিন শুনানির রায় না হওয়ায় তারা রাস্তায়ই অবস্থান নেন। পরে বৃহস্পতিবার (২২ মে) ওই রিট খারিজ করেন আদালত। তখন সরকারকে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা সময় দিয়ে রাস্তা ছাড়েন ইশরাক ও তার সমর্থকরা।

যদিও মেয়র পদে শপথের দাবিতে শনিবার (২৪ মে) ও আজ রোববারও (২৫ মে) নগর ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন তারা। দাবি আদায়ে নগর ভবনে এখনো তালা ঝুলিয়ে রেখেছেন ইশরাকের সমর্থকরা। ফলে করপোরেশনের নাগরিক সেবা কার্যক্রম ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দাপ্তরিক কাজ বন্ধ। অনেক সেবাপ্রার্থী নগর ভবনের ফটক থেকে ফিরে গেছেন বলে জানা যায়।

জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জিল্লুর রহমান  বলেন, ‘১১ দিন ধরে নগর ভবনে তালা ঝুলিয়ে রেখেছেন আন্দোলনকারীরা। এতে করপোরেশনে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী ঢুকতে পারছেন না। নাগরিকরা সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন। এ অচলাবস্থা কবে কাটবে জানা নেই।’

অচলাবস্থার বিষয়টি সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে জিল্লুর রহমান বলেন, ‘নগর ভবনে থাকা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়েও তালা লাগানো। তারা বিষয়টি অবগত আছেন। এখন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, উচ্চ আদালত, নির্বাচন কমিশনই এ সমস্যার সমাধান করতে পারেন।’

ইশরাকের শপথে আইনগত যত বাধা
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গেজেট প্রকাশের পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মেয়র হিসেবে ইশরাক হোসেন শপথ নিতে পারবেন কি না, সেটি স্পষ্ট করা হয়নি সরকারের পক্ষ থেকে। কারণ, আইনি অনেক জটিলতা রয়েছে। যেমন, গত ৩ আগস্ট গোপনে দেশ ছাড়েন শেখ ফজলে নূর তাপস। পরে ২৬ সেপ্টেম্বর তাপসসহ দেশের সব সিটি মেয়র ও কাউন্সিলরদের অপসারণ করে সরকার।
আবার শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র নির্বাচনের সাড়ে চার মাস পর (১৬ মে, ২০২০) ডিএসসিসির মেয়রের দায়িত্ব নেন। ২০২০ সালের ২ জুন করপোরেশনের সব কাউন্সিলরকে নিয়ে প্রথম বোর্ড সভা করেন শেখ তাপস। স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন-২০০৯ অনুযায়ী, মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম বোর্ড সভা থেকে তার মেয়াদকাল শুরু হয়। অর্থাৎ, নতুন মেয়র যেদিন কাউন্সিলরদের নিয়ে প্রথম সভা করেন, সেদিন থেকেই শুরু হয় তার পাঁচ বছরের মেয়াদকাল। এই হিসাবে আগামী ১ জুন পর্যন্ত শেখ তাপস মেয়রের দায়িত্বে থাকার কথা ছিল। এখন যদি ইশরাক হোসেন শপথ নেন, ১ জুনের আগেই দায়িত্ব ছাড়তে হবে।
অথচ একজন মেয়র পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। এমন অবস্থায় ইশরাককে শপথ পড়ালে ফের সিটি করপোরেশন নির্বাচন চলে আসবে। আবার যদি ইশরাক চেয়ারে বসে দায়িত্ব ছাড়তে না চান, নিজেকে পাঁচ বছরের জন্য মেয়র পদের বৈধতায় উচ্চ আদালতের রায় নিয়ে আসেন তাহলে আরেক জটিলতা হবে। তাই শপথ নিয়ে গড়িমসি করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
জানতে চাইলে সম্প্রতি ইশরাক হোসেন বলেন, ‘একজন মেয়র শপথ নেওয়ার পর কতদিন দায়িত্ব পালন করবে তা স্থানীয় সরকার আইনে বলা আছে। এখন মেয়রের সময় নিয়ে যে জটিলতা দেখানো হচ্ছে, তা যুক্তিসঙ্গত নয়। আমি মনে করি, আমি পাঁচ বছরের জন্যই নির্বাচিত হয়েছি।’
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ সম্প্রতি  বলেন, ‘এখন স্থানীয় সরকার সংস্কারের কাজ চলছে। এর আগে সিটি নির্বাচন দিলে তো সংস্কারের দরকার হয় না। তাহলে তো সে আগের অবস্থায়ই রয়ে যাবে। আবার সংস্কার ছাড়া ইশরাক শপথ নিলে কয়েক দিন পর যদি আবার নতুন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়, তখন কী হবে? এসব বিষয়ে আইনে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। এমন পরিস্থিতিতে সবার স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কী করবে।’