এপি'র প্রতিবেদন

অভ্যুত্থানের এক বছর পর বিভক্ত বাংলাদেশ: ঐক্যের পরিবর্তে দ্বন্দ্বের রাজনীতি

ডেস্ক রিপোর্ট
  ১৬ জুলাই ২০২৫, ১৩:৪০

২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন এবং তার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশে নতুন সূর্যোদয়ের আশায় বুক বেঁধেছিল অনেকে। কিন্তু এক বছর পর আশার সেই আলো ম্লান হয়ে এসেছে, রাজনৈতিক বিভক্তি ও অনিশ্চয়তা বেড়েছে। 
ড. মুহাম্মদ ইউনূস শান্তি, গণতন্ত্র ও সংস্কারের প্রতিশ্রুতি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিলেও, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তার প্রশাসন নানা জটিলতার মধ্যে পড়েছে। সহিংসতার বিক্ষিপ্ত ঘটনার পাশাপাশি দেখা দিচ্ছে গভীর মতবিরোধ, আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা।
রাজনীতিতে নতুন খেলোয়াড়, পুরনো উত্তেজনা
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—এই দুই পুরোনো রাজনৈতিক শক্তিকে উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীদের একাংশ ‘জাতীয় নাগরিক দল’ বা এনসিপি গঠন করেছে। তারা নতুন ধারা ও সংস্কারের কথা বললেও, তাদের বিরোধীরা অভিযোগ করছে—এনসিপি আসলে ইউনূস সরকারের প্রশ্রয়ে বিকশিত এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে নিজেদের অবস্থান শক্ত করছে।
এদিকে হাসিনা সরকারের শাসনামলের দমননীতি কাটিয়ে এক দশকেরও বেশি সময় পর জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। স্বাধীনতা বিরোধী অবস্থানের জন্য অতীতের ভার বহন করা এই দল আবার সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরেছে এবং এতে ভোটের মাঠে বিভাজন আরও তীব্র হয়েছে।
অন্যদিকে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচার শুরু হওয়ায় তার দল আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যা রাজনীতিতে এক বড় শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। সেই ফাঁকা জায়গা পূরণে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি সক্রিয় হলেও পারস্পরিক দ্বন্দ্ব পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করেছে।
সংস্কার ইস্যুতে মতবিরোধ
নির্বাচনের আগে সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের বিষয়ে একমত হলেও, কোন সংস্কার আগে এবং কতটুকু পরিবর্তন জরুরি—তা নিয়ে মতপার্থক্য তীব্র। প্রধানমন্ত্রিত্বে মেয়াদ নির্ধারণ, সংসদ কাঠামোয় পরিবর্তন এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার মতো বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা চললেও চূড়ান্ত ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি।
জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘ সময় চায় সংস্কার সম্পন্ন করতে, অন্যদিকে বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হতে চায়। এনসিপির অবস্থান জামায়াতের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ হওয়ায় এই বিভাজন আরও প্রকট হয়ে উঠেছে।
মানবাধিকার সংকট ও ইসলামপন্থিদের উত্থান
ড. ইউনূস সরকার একদিকে বলপূর্বক গুম-হত্যা বন্ধ করলেও, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় ঘাটতি এবং বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দমননীতির অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা এবং শেখ হাসিনার সমর্থকেরা ব্যাপক ধরপাকড়ের অভিযোগ তুলেছেন।
এই সুযোগে বিভিন্ন ইসলামপন্থি দল নির্বাচনের মাঠে জোট বাঁধার চেষ্টা করছে, কেউ কেউ শরিয়া আইনের প্রবর্তন এবং নারী অধিকারে সীমাবদ্ধতা আনার প্রস্তাব দিচ্ছে, যা দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
বৈশ্বিক মঞ্চে বাংলাদেশ
শেখ হাসিনার আমলে ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র থাকলেও, ইউনূস প্রশাসন চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে। তার প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর ছিল চীনে, যেখানে বিনিয়োগ ও ঋণ নিয়ে চুক্তি হয়েছে। বিপরীতে, ভারত শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ চাহিদা উপেক্ষা করেছে এবং বাংলাদেশের ভিসা কার্যক্রম কার্যত স্থবির করে রেখেছে।
তবে পশ্চিমা বিশ্ব ও জাতিসংঘ এখনো ড. ইউনূসের সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও, নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে এসেছে মার্কিন রাজনীতির পরিবর্তন। ট্রাম্প প্রশাসনের তহবিল স্থগিতাদেশের ফলে ইউএসএআইডির সহায়তা বন্ধ হয়ে গেছে, যা বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনায় বড় ধাক্কা।