প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর

‘শেখ হাসিনা দিছে, বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাইছি’

নিজস্ব প্রতিবেদক, রামগতি (লক্ষ্মীপুর)
  ১০ আগস্ট ২০২২, ১৫:০৪

‘সত্তরের বন্যায় বঙ্গবন্ধু রিলিফ দিছে। খাইয়া-পইরা বাঁইচা ছিলাম। এখন শেখ হাসিনা ঘরবাড়ি দিছে। এর উছিলায় আল্লাহ আমারে চালায়, আমি চলি। শেখ হাসিনার জন্য দোয়া করি।’
এভাবেই যাপিত জীবনের গল্প নিজের ভাষায় বলছিলেন লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চর বাদাম ইউনিয়নের চরসীতা গ্রামের শাহ আলম (৭০)।
সত্তর সালের আগে বাড়িঘর ও দোকানপাট সবই ছিল। দোকান করে পরিবার নিয়ে ভালোই চলতো শাহ আলমের। কিন্তু প্রলয়কারী ঘুর্ণিঝড় আর বন্যায় এলাকা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। প্রকৃতির বিধ্বংসী আচরণের পাশাপাশি মানুষের আঘাতে শাহ আলমের শ্রবণশক্তি হারায়।তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ করার কারণে অনেক মাইর খাইছি। ভোট করতে গিয়া মাইর খাওয়ার পর থেকে কানেও শুনি না।


৭০-এর বন্যার ভয়াবহতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ৭০-এর বন্যার সময় আমার বয়স ১৮ বছর। বন্যায় আমাদের বাড়ির ২৩ জন মানুষ মারা গেছে। আর আমরা ২৬ জন মানুষ একটা বরই গাছ ধরে টিকে ছিলাম। পানি আস্তে আস্তে কমছে, আমরা আস্তে আস্তে নামায় (নিচে) নামছি। এভাবে নামতে নামতে বেগ্গুন (সবাই) মানুষ ফিট হই গেছি। পরে রৌদ ওঠার পর (হুঁশ ফেরায়) যে যেমনে কাব্বাইতে ঘরের ভিটার ওপরে এসে পড়ছি। পরে কসর চেয়ারম্যানে মানুষ এগুলোরে টোগাই টোগাই (খুঁজে খুঁজে) চাউল কগা (কিছু) দিছে। এভাবে রিলিফ আইছে। আর মানুষ আস্তে আস্তে বাঁচছে।
এভাবে সেসময় বঙ্গবন্ধুর সরকারের দেওয়া রিলিফ দিয়ে কোনো মতে বেঁচে ছিলেন শাহ আলম ও তার প্রতিবেশীরা। পরে বঙ্গবন্ধু ২১০ পরিবারকে গুচ্ছগ্রামে আশ্রয় দেন। প্রতি পরিবার পায় ২.৫ একর জমি। তারা বনে যায় জমিদার। কিন্তু শাহ আলমদের ভাগ্য বদলায়নি। ওই তালিকায় তার নাম ওঠেনি। 
তবে সেসময় বঙ্গবন্ধুর করা গুচ্ছগ্রামে তিনিও শ্রমিক ছিলেন। সে স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু যে সময় এই পোড়াগাছায় মাটি কাটতে আইছে (গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প উদ্বোধনে), আমিও মাটি কাটতে গেছিলাম। বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টারে আইয়া (এসে) নামছে, আজাদ চেয়ারম্যান মাটি কাইটা দিছে, আমরা উঠাই ফালাইছি।
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনের বাড়িতে বা সরকারি খাস জমিতে বাস করেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন শাহ আলম-জান্নাত দম্পতি। ২ ছেলে ও ২ মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। এখন তাদের শেষ জীবনে সুখের হাতছানি এনে দিয়েছে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প। তাদের ২ শতক করে জমি ও সেমিপাকা ঘর দেওয়া হয়েছে।
শাহ আলমের স্ত্রী জান্নাত বলেন, আমরা দুঃখিয়া, কিছু ছিল না। ঘরবাড়ি দিছে, আল্লাহ দিলে এখন সুখে আছি।
শাহ আলম বলেন, শেখ হাসিনার অসীম দয়ায় ঘর পাইছি। ঘর পেয়ে আমি খুব আনন্দিত। আমাগো তন আনন্দ লাগতেছে। এটা না পাইলে একজনের বেড়ির কানিত থাকতে হইতো। নাইলে একজনের পাও ধরতে হইতো। নয় মানুষের লাত্থি খাইতে হইতো। আল্লাহ দয়া করছে, শেখ হাসিনা দিছে, আমরা এই বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাইছি।
তিনি বলেন, আগের তনে এহন খুব ভালা আছি। সেখানে বহু কষ্টে ছিলাম। এখন খাইয়া থাকি, আর না খাইয়া থাকি, ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে পারি, শান্তিত ঘুমাইতে পারি। সমস্যা একটা, আমাদের কবরস্থান নাই।
শেখ হাসিনার উপহারের ঘর পেয়ে সেখানে জাল বুনে বিক্রি করে জীবন চালাচ্ছেন শাহ আলম। তার মতো পূর্ব চর সীতার ৭৫টি পরিবার এভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বঞ্চনার জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবার শক্তি পেয়েছে।
এ বিষয়ে রামগতি উপজেলা নির্বাহী অফিসার শন্তনু চৌধুরী  বলেন, রামগতি উপকূলীয় উপজেলা। মেঘনার ভাঙন ও নানা দুর্যোগ দুর্বিপাকে এই এলাকার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন নানান সময়ে। সেজন্য এখানে সরকারের নজরও ছিল সব সময়। ১৯৭০ সাল থেকে এ পর্যন্ত রামগতিতে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় ২ হাজার ৯৩২ পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় আমরা প্রথম ধাপে ৫৭০ ও তৃতীয় ধাপে ৩৯০টি পরিবারকে উপহারের ঘরবাড়ি করে দিয়েছি।
লক্ষ্মীপুরের জেলা প্রশাসক মো. আনোয়ার হোছাইন আকন্দ  বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত এই জেলাটির ভূমিহীন ও গৃহহীনদের পুনর্বাসনে আমরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আবেগের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় লক্ষ্মীপুরের দুটো উপজেলা ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করতে পেরেছি। আশা করছি শিগগিরই বাকি উপজেলাগুলোও ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত হবে।
১৯৭২ সালে রামগতিতে করা বঙ্গবন্ধুর গুচ্ছগ্রামের ধারণা থেকে এখন তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারাদেশে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের মাধ্যমে সারাদেশে ভূমিহীন গৃহহীনদের পুনর্বাসন করছেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা- ‘বাংলাদেশের একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না।’ এরই মধ্যে পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে দেশের ৫২টি উপজেলা ভূমিহীন ও গৃহহীন করেছে সরকার।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে সারাদেশে ৫ লাখ ৯ হাজার ৩৭০ পরিবারকে ভূমি ও সেমিপাকা ঘর করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্বাহী সেল ৭ হাজার ৮০৯ পরিবার, ভূমি মন্ত্রণালয় ৭২ হাজার ৪৫২ পরিবার, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ৪ হাজার ২৩৭ পরিবার, বাংলাদেশের গৃহায়ণ তহবিল থেকে ৮৮ হাজার ৭৮৬ পরিবার এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ২৮ হাজার ৬০৯ পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এভাবে সারাদেশে মোট ৭ লাখ ১১ হাজার ৬৩ পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।