বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী জোটবদ্ধ অবস্থান থেকে একে অপরকে ছেড়ে দেওয়া সংক্রান্ত একটি গোপন সিদ্ধান্ত ফাঁস হয়ে গেছে। এক বছর আগে গোপন বৈঠকে নেওয়া সিদ্ধান্তটি গত শনিবার জামায়াতে ইসলামীর একটি ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান। তার ওই বক্তব্যের একটি ভিডিও ফাঁস হয়ে গেলে সিদ্ধান্তটি প্রকাশ পায়। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে জোট ত্যাগের বিষয়টি বিএনপি বা জামায়াতÑ কোনো দলের পক্ষ থেকেই স্বীকার করা হয়নি। বরং জামায়াতের আমিরের ‘অসতর্কমূলক’ বক্তব্যকেই দুষছেন নেতারা। গত বছরের আগস্টে রাজধানীর উত্তরায় বিএনপি ও জামায়াতের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কয়েক নেতার মধ্যে গোপন বৈঠকটি হয়েছিল। এতে একে অপরকে ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তটি গোপন রাখার বিষয়েও একমত হয়েছিলেন নেতারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গোপন থাকল না।
জামায়াতের আমিরের ভিডিও ফাঁসের ঘটনায় বিএনপি নেতারা স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। তবে অস্বস্তিতে পড়েছে জামায়াত। এ বিষয়ে জামায়াতের প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ তার দলের অবস্থান তুলে ধরে আমাদের সময়কে বলেন, ‘২০-দলীয় জোট ছাড়া বা না ছাড়া এটি একটি বিশদ আলোচনার ব্যাপার। এটা বক্তব্যের বিষয় নয়। আমরা যদি কোনো সিদ্ধান্ত নিই, তা হলে তা সংবাদ সম্মেলন করে অথবা সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেই।’
২৩ বছর আগে ১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়তে গিয়ে বিএনপি-জামায়াতসহ চারদলীয় জোট গঠন হয়। একসঙ্গে আন্দোলনের পর এই জোট ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে
ব্যাপক সাফল্য পায় এবং সরকার গঠন করে। শুরুর দিকে চারদলীয় জোটের শরিক ছিল এইচএম এরশাদের জাতীয় পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট ও জামায়াতে ইসলামী। একপর্যায়ে এরশাদ চার দল ছেড়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে গেলে জাতীয় পার্টির নেতা নাজিউর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বে দলটির একটি অংশ (যা পরে বিজেপি হয়) চার দলে থেকে যায়। চারদলীয় জোট পরে ২০-দলীয় জোটে রূপান্তরিত হয়। জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠনের কঠোর বিরোধিতা করে তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধাবিষয়ক সম্পাদক এবং বর্তমানে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কবির হোসেন, যার কারণে তাকে রাজনৈতিকভাবে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
অষ্টম জাতীয় সংসদ থেকে একাদশ সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত প্রায় ২০ বছর একসঙ্গে আন্দোলন ও নির্বাচন করার পর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণে দল দুটির মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ২০১৮ সালে কারাগারে গেলে এ দূরত্ব আরও বাড়ে।
এই অবস্থায় ২০-দলীয় জোটকে গুরুত্বহীন রেখে গণফোরামের ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্র্বাচনে অংশগ্রহণ করে। সেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও ঘোষণা ছাড়াই ভেঙে গেছে। এই জোটের শরিকরা গণতান্ত্রিক মঞ্চ নামে নতুন জোট গঠন করেছে। এই অবস্থায় ২০-দলীয় জোটের অবস্থান জানতে চাইলে জোটের সমন্বয়ক ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমি এখন পর্যন্ত জামায়াতের আমিরের বক্তব্য শুনতে পাইনি। তারপরও বলব ২০-দলীয় জোট এখনো আছে, এটা ভাঙা হয়নি।’
বিএনপি নেতাদের সূত্রে জানা যায়, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতের শীর্ষ নেতারা গ্রেপ্তার, তাদের বিচার শুরু এবং রায় কার্যকরÑ এর বিরুদ্ধেই ছিল দলটির মূল আন্দোলন। তারা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চেয়ে জ্বালাওপোড়াও আন্দোলন নিয়ে বেশি সময় ব্যয় করে। এক পর্যায়ে প্রশাসনের চাপে প্রকাশ্যে আন্দোলন করা ছেড়ে দেয় দলটি। জোটসঙ্গী জামায়াতের অগণতান্ত্রিক কর্মকা-ের নেতিবাচক ছোঁয়া লাগে বিএনপির গায়েও। এ নিয়ে বিএনপির ভেতরে জামায়াত নিয়ে অস্বস্তি বাড়ে।
সূত্র আরও জানায়, আন্তর্জাতিক চাপের পাশাপাশি নিজ দলের মধ্যেও জামায়াত ত্যাগের বিষয়ে জোরালো দাবি ওঠে বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরামে। এই অবস্থায় বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব ওই সময়ে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত দেয়, জামায়াত নিজে থেকে বিএনপির সঙ্গ ত্যাগ করতে চাইলে তাদের বাধা দেওয়া হবে না। তবে বিএনপি জামায়াত সঙ্গ ত্যাগের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবে না।
জামায়াতের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র বলছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর জামায়াতের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরার বৈঠক হয়। এতে প্রতিকূল পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আর জোটে না থাকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় জামায়াতে ইসলামী। এ ছাড়া বিএনপিও জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায় না। এই অবস্থায় গত বছরের আগস্ট মাসে বিএনপি ও জামায়াত উভয় দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে একটি গোপন বৈঠক হয়। বৈঠকে ভবিষ্যতে কেউ কারও বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য বা বিবৃতি দেবে না- এই শর্তে একে অপরকে ত্যাগের সিদ্ধান্ত হয়। সেক্ষেত্রে উভয় পক্ষ এই সিদ্ধান্ত গোপন রাখবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়।
এই অবস্থায় সম্প্রতি দলের বিভিন্ন ফোরামে জামায়াতের এই সিদ্ধান্ত দলের আমির ডা. শফিকুর রহমান তার বক্তব্যে তুলে আনছিলেন। গত ১৪ আগস্ট ঢাকা মহানগরের মজলিশে শূরার বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে অংশ নেওয়া একজন জামায়াত নেতা আমাদের সময়কে বলেন, ‘সেখানে জামায়াতের আমির ড. শফিকুর রহমান সাহেব বলেছেন, জামায়াত বিএনপি জোটে এখন আর নেই। এ বিষয়টি সবার গোপন রাখতে হবে।’
সর্বশেষ গত শনিবার এক ভার্চুয়াল সভায় ডা. শফিক বক্তব্য দেন। তার ওই বক্তব্যের একটি ভিডিও ফাঁস হয়। এই নিয়ে জামায়াতের মধ্যেও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে জামায়াতের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়েছে বলে আমাদের সময়কে জানান জামায়াতের এক নেতা। তিনি বলেন, জামায়াত যেখানে তার সিদ্ধান্ত এতটাই গোপনীয়তার মধ্যে রাখতে পারে, সেখানে আমিরের বক্তব্য ফাঁস তাদের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য হুমকি। দলের সেক্রেটারি জেনারেলসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতারা কারাগারে, সেখানে আমিরের এই বক্তব্য তাদের মধ্যে সন্দেহ আরও বাড়িয়ে দেবে।
ফাঁস হওয়া ভিডিওতে ডা. শফিকুর রহমানকে বলতে শোনা যায়, ‘আমরা এতদিন একটা জোটের সঙ্গে ছিলাম। ছিলাম বলে আপনারা হয়তো ভাবছেন কিছু হয়ে গেছে নাকি? আমি বলি হয়ে গেছে। ২০০৬ সাল পর্যন্ত এটি একটি জোট ছিল। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর জোট তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। সেদিন বাংলাদেশ পথ হারিয়ে ছিল। সেটা আর ফিরে আসেনি। তিনি আরও বলেন, বছরের পর বছর পর এই ধরনের অকার্যকর জোট চলতে পারে না। এই জোটের সঙ্গে বিভিন্ন দলের যারা আছেন, বিশেষ করে প্রধান দলের (বিএনপি) এই জোটকে কার্যকর করার কোনো চিন্তা নাই। বিষয়টা আমাদের কাছে স্পষ্ট দিবালোকের মতো এবং তারা আমাদের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন বাস্তবতা হচ্ছে নিজস্ব অবস্থান থেকে আল্লাহর ওপর ভর করে পথচলা। তবে হ্যাঁ জাতীয় স্বার্থে একই দাবিতে যুগপৎ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করব ইনশাল্লাহ।’
বিএনপির সঙ্গে জোট নিয়ে আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে জামায়াতের আমির বলেন, ‘আমরা তাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছি, এর সঙ্গে তারা ঐকমত্য পোষণ করেছে। তারা আর কোনো জোট করবে না। এখন যার যার অবস্থান থেকে সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করব। যদি আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করেন তা হলে আমাদের আগামী দিনগুলোতে কঠিন প্রস্তুতি নিতে হবে এবং অনেক বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।’
জামায়াতের আমিরের ফাঁস হওয়া বক্তব্য প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান টুকু আমাদের সময়কে বলেন, সব সত্য কথা তো জামায়াতের আমির বলে দিয়েছেন। তিনি এ-ও বলেছেন বিএনপির সঙ্গে তাদের আলোচনাও হয়েছে। এখানে তো মন্তব্য করার কিছুই নেই।
জানতে চাইলে জামায়াতের প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘জোট ছাড়তে হলেও তো দলের সভা বা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে হয়। কিন্তু দলের মধ্যে এ ধরনের কোনো সভা বা আলোচনা হয়নি।’
জামায়াতের একটি সূত্রের দাবি, ২০২১ সালের ৩০ অক্টোবর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনাসভায় জামায়াতের এক নেতা বলেছিলেন, ‘২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর পুরানা পল্টনে জামায়াতের সমাবেশে হামলা ও দলটির অনুসারী কয়েকজনের মৃত্যুর জন্য বিএনপি দায়ী।’ তার এমন বক্তব্যের প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, এই জামায়াত বাংলাদেশকে আজ এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। এসবই জামায়াতের ফাজলামি। তার এই বক্তব্যের পর জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মীদের কথার বাহাস চলে।
এরপর ২০২২ সালের ২ এপ্রিল জাতীয় প্রেসক্লাবে বিএনপির প্রতীকী অনশন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে মারধরের শিকার হয় জামায়াতের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমির নূরুল ইসলাম বুলবুলসহ কয়েকজন কর্মী। এই দুই ঘটনার পর থেকে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব আরও বাড়ে। এই অবস্থার মধ্যে জামায়াতের আমির জোট ছাড়ার ঘোষণা দেন।