নিয়মিত অফিস করছেন ‘পলাতক’ আসামি

নিজস্ব সংবাদদাতা
  ৩০ আগস্ট ২০২২, ১২:৩০

স্বল্প আয়ের মানুষের মানসম্মত আবাসন নিশ্চিতে কাজ করে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ (জাগৃক)। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য আবাসন নয়, নিজেদের আখের গোছাতেই যেন ব্যস্ত। তাদের এ ধরনের অপকর্মে বেহাত হচ্ছে শত শত কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি। অভিযোগ রয়েছে, অনিয়ম-দুর্নীতির একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে জাগৃকে। এই সিন্ডিকেটে জড়িতদের বিরুদ্ধে যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তা যৎসামান্য; অনেকটাই লোকদেখানো। সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ, ঘুষ লেনদেন, অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ নানা অভিযোগের প্রমাণ থাকলেও সিন্ডিকেটের সদস্যদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন জাগৃকের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
জ্ঞাত আয়বহির্ভূত লাখ লাখ টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত ৮ মার্চ জাগৃকের ভূমি ও সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা দপ্তরের অফিস সহকারী মো. মোস্তফা কামাল শাহীন ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপপরিচালক মো. মোশারফ হোসেইন মৃধা। গুরুতর এই মামলার পরও কর্মজীবনে প্রভাব পড়েনি মোস্তফা কামালের। জাগৃকের প্রধান কার্যালয়ে নিয়মিত অফিস করছেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, দুদকের মামলায় আদালত তাকে ৪ সপ্তাহের আগাম জামিন দেন গত এপ্রিল মাসে। কিন্তু জামিনের সেই মেয়াদ শেষ হয়ে ৩ মাস কেটে গেলেও আর আদালত চত্বর মাড়াননি তিনি। জামিন না নিয়েই দিব্যি অফিস করে যাচ্ছেন ওই অফিস সহকারী। গতকাল সোমবার দুপুরেও জাগৃকের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, কাজ করছেন মোস্তফা কামাল। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা দুদকের মামলার নথি হাতে পেলেও রহস্যজনক কারণে জাগৃকের কর্মকর্তারা বলছেন, এ বিষয়ে কোনো তথ্য তাদের কাছে কাছে।
দুদক সূত্র জানায়, দুদকের মামলা ও তদন্তকাজ থানাপুলিশ বা শৃঙ্খলাবাহিনীর অন্য কোনো সংস্থার মতো নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুলিশ আগে মামলা নেয়, পরে তদন্ত করে সত্য উদ্ঘাটন করে। আর দুদক আগে দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় অনুসন্ধান শেষে অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত হয়ে তবেই মামলা করে। তাও অনুসন্ধান কর্মকর্তার একক ইচ্ছায় নয়; অভিযোগের সত্যতা তথ্যপ্রমাণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই কেবল মামলার সুপারিশ করে কমিশনে প্রতিবেদন জমা দেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। কমিশন সন্তুষ্ট হয়ে তাতে অনুমোদন দিলেই দুদক বাদী হয়ে মামলা করে। এরপর সংস্থাটির কর্মকর্তারাই তদন্ত করে প্রতিবেদন দেন। ফলে স্বাবিকভাবেই বলা চলে, মোস্তফা কামাল শাহীন ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদক যে মামলা করেছে, তাতে দুর্নীতির ‘উপাদান’ রয়েছে।
দুদকের মুখ্য আইনজীবী খুরশীদ আলম খান গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, দুদক কোনো মামলা করলে অনুসন্ধান শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত অভিযুক্তকে সাময়িক বরখাস্ত রাখার নিয়ম রয়েছে। এটা করে যে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, সেই প্রতিষ্ঠান। জামিনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আসামিকে পলাতক হিসেবেই গণ্য করা হয়। আর পলাতক আসামি কখনো অফিস করতে পারেন না। আদালতকে অশ্রদ্ধা করে জাগৃকের অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি জামিন না নিয়ে অফিস করেন তা হলে সুস্পষ্ট আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন তিনি। আর তা যদি প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সামনেই করে থাকেন, ধরে নেওয়া যায় ‘শর্ষের ভেতরেই ভূত’ রয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে জাগৃকের সদস্য (প্রশাসন ও অর্থ) অতিরিক্ত সচিব মো. শাহজাহান আলী বলেন, শাহীনের বিরুদ্ধে দুদক যে মামলা করেছে তা আমি অবগত নই। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। একই ধরনের মন্তব্য করেন জাগৃকের আইন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানও। অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করলেও এ প্রসঙ্গে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি মোস্তফা কামাল শাহীন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক মো. মোশারফ হোসেইন মৃধা বলেন, তথ্য-প্রমাণের ওপর ভিত্তি করেই জাগৃকের ওই অফিস সহকারী ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তদন্তাধীন বিষয়ে আর কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।
দুদকের মেট্রো বিশেষ মামলায় (নম্বর-৭৭/২০২২) উল্লেখ করা হয়, মোস্তফা কামাল তার সম্পদ বিবরণীতে স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে ৭৮ লাখ ১৩ হাজার টাকার সম্পদ প্রদর্শন করেন। কিন্তু অনুসন্ধানকালে প্রাপ্ত রেকর্ডপত্র অনুযায়ী দেখা যায়, অভিযুক্তের নামে অর্জিত/প্রাপ্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মূল্য ৭৬ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। শুধু এই অভিযোগই নয়, প্লট বরাদ্দ দেওয়ার কথা বলে হোসনে আরা ইসলাম নামে এক নারীর কাছ থেকে ২৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে মোস্তফা কামালের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি দুদক চেয়ারম্যানের দপ্তরে একটি লিখত অভিযোগ জমা দেন ওই ভুক্তভোগী। অভিযোগে হোসনে আরা ইসলাম উল্লেখ করেন, তিনি রাজধানীর রূপনগরের দুয়ারীপাড়া এলাকায় ৮ নম্বর সেকশনের ৪ নম্বর সড়কের ব্লক খ-এর ২ নম্বর প্লটে দীর্ঘদিন ধরে ঘর তুলে সপরিবারে বসবাস করেন। জাগৃক থেকে প্লটটি তাকে বরাদ্দ নিয়ে দেওয়ার কথা বলে মোস্তফা কামাল শাহীন ও তার এক সহযোগী ২০১৪-২০১৫ সালের ৬ মাসেই ওই নারীর কাছ থেকে ২৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়।