প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ৫-৮ সেপ্টেম্বর বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ভারত সফর করবেন। প্রতিবেশী দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে সাড়া দিচ্ছেন তিনি। দীর্ঘ তিন বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এ সফরে সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তির (সেপা) আশা করা হচ্ছে। এ ছাড়া ভারত থেকে জ্বালানি তেল আমদানির বিষয়টি গুরুত্ব পেতে পারে। একই সঙ্গে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনের বিষয়েও সিদ্ধান্ত হতে পারে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রতিবেশী ভারতকে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এ লক্ষ্যে দেশটির বাজারে আরও বেশি বাণিজ্য সুবিধা সৃষ্টির জন্য কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (সেপা) চুক্তি স্বাক্ষরের কাজ চলছে। এর ফলে দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের নতুন দ্বার খোলার সুযোগ তৈরি হবে।
বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিএফটিআইয়ের প্রাথমিক সমীক্ষা বলছে- ভারতের সঙ্গে সেপা চুক্তি হলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যসংক্রান্ত বাধা দূর হবে। তখন যৌথ টেস্টিং সার্ভিস, ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু হবে। এতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে বর্তমান (প্রায় ১.২৮ বিলিয়ন ডলার) রপ্তানি আয়ের বাইরে আরও ৩ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে। সমীক্ষায় আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আমদানি চিত্রও পাল্টে যাবে। ভারতের বেশিরভাগ পণ্য ও সেবা বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে সহনীয় এবং সময় ও পরিবহন খরচ কম হওয়ার কারণে একই পণ্যের জন্য দূরপ্রাচ্যের বদলে ভারতমুখী হবেন বাংলাদেশি আমদানিকারকরা। সে ক্ষেত্রে বর্তমান ৭ বিলিয়ন ডলারের আমদানি আরও ৪ থেকে ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বেড়ে যাবে।
বর্তমানে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে দক্ষিণ এশীয় মুক্তবাণিজ্য চুক্তি বা সাফটার অধীনে বাণিজ্য হচ্ছে। এ ছাড়া স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে উন্নয়নশীল দেশ ভারতের কাছ থেকে আরও কিছু বাণিজ্য সুবিধা পাচ্ছে বাংলাদেশ। ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য যেমন বাড়ছে, তেমনি ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানিও গতি পেয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন চুক্তির ব্যাপ্তি অনেক বেশি হওয়ায় বর্তমানে চলমান মুক্তবাণিজ্য চুক্তি থেকে এটির অনেক ভিন্নতা রয়েছে। এটি স্বাক্ষরিত হলে উভয় দেশের বাণিজ্যই শুধু বাড়বে না, উন্মুক্ত হবে বিনিয়োগের নতুন দরজা। এ ছাড়া নতুন এ চুক্তিতে পণ্য ও সেবা বাণিজ্য, বিনিয়োগ, মেধাস্বত্ব ও ই-কমার্সের মতো অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর আমাদের সময়কে বলেন, দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় চুক্তি সব সময় বাণিজ্যে ইতিবাচক প্রভাব রাখে। এতে শুল্ক বাধা দূর হয়। বিনিয়োগ আকৃষ্ট হয়। বিনিয়োগ বাধাও দূর হয়।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে বেশকিছু বিষয়ে মধ্যে জ্বালানি তেল আমদানিতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতে পারে। বৈশ্বিক সংকটের কারণে এ মূহূর্তে বাংলাদেশ সংকটে পড়লেও সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে ভারত। রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশ থেকে জ্বালানি তেল আমদানি অব্যাহত রেখেছে তারা। ফলে এ সুযোগ কাজে লাগাতে চায় ঢাকা।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে ভারতের নুমালীগড় তেল পরিশোধন কেন্দ্র থেকে দিনাজপুরের পার্বতীপুর পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। এ পাইপলাইন দিয়ে ডিজেল আমদানি করা হবে। এ ছাড়া ভারতের বেসরকারি কোম্পানি আদানির কাছ থেকে ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি করেছে বাংলাদেশ।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ভারত থেকে পাইপলাইনে গ্যাস আমদানির বিষয়েও আলোচনা চলছে দীর্ঘদিন। ভারত হয়ে খুলনা পর্যন্ত পাইপলাইন স্থাপন করা হবে। ভবিষ্যতে ভারত থেকে পাইপলাইনে গ্যাস আমদানির কথাও ভাবছে বাংলাদেশ।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ভারত-বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির ইস্যুতে আলোচনা চলছে। দিল্লি চায় ভারতের কার্তিহার-পার্বতীপুর এবং বড়নগর পর্যন্ত বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে একটি বৈদ্যুতিক গ্রিড লাইন নির্মাণ করতে। এদিকে নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করতে চায় বাংলাদেশ। ভুটান থেকেও জলবিদ্যুৎ আমদানি করতে চায় ঢাকা। ফলে ভারত-বাংলাদেশ এবং ভুটানের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির বিষয়েও আলোচনা চলছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের পরমার্শক সংস্থা পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন আমাদের সময়কে বলেন, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অনেক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা রয়েছে। তবে এবার প্রধান্ত্রীর সফরে প্রাধান্য পেতে পারে জ্বালানি তেল আমদানির বিষয়টি। তিনি বলেন, জ¦ালানি তেল আমদানি ছাড়াও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইস্যু রয়েছে। রামপালের নির্মাণ কাজ প্রায় শেষের দিকে।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ৫ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে পৌঁছবেন। এবার তার সফরসঙ্গী হচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
মূলত ৬ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের মূল কার্যদিবস শুরু হবে। সেদিন সকালে আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনা শেষে শুরু হবে বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় বৈঠক। দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে দিনভর নানা বৈঠক শেষে দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে একটি যৌথ ঘোষণাপত্র জারি করা হবে। পরের দিন সকালে ভারতীয় সংগঠনগুলোর প্ল্যাটফরমে ভাষণ দেবেন শেখ হাসিনা। সেখানে ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করবেন তিনি। ওই দিনই তিনি পাড়ি দেবেন রাজস্থানের পবিত্র আজমির শরিফ দরগায়।
এর পর রাজস্থানের রাজধানী জয়পুরের বিমানবন্দর থেকে বৃহস্পতিবার (৮ সেপ্টেম্বর) ঢাকার উদ্দেশে ভারত ত্যাগ করবেন।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, মুজিববর্ষ উদযাপন এবং বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত ২০২১ সালের ২৬-২৭ মার্চ বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সফর করেন।