প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর

বাংলাদেশের প্রাপ্তি ও অঙ্গীকার

নিজস্ব সংবাদদাতা
  ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১:৩১

টানা ১৩ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন অন্য যে কোনো সময়ের থেকে দৃঢ়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের ভারত সফর শেষে বৃহস্পতিবার দেশে ফিরেছেন। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বোঝাপড়া, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতি, বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন, যুদ্ধ-সংঘাতের কারণে জ্বালানিসহ নিত্যপণ্যের সরবরাহে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকটের কারণে শেখ হাসিনার এবারের সফরটি ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিস্তার পানিবণ্টনসহ প্রত্যাশিত দ্বিপাক্ষিক অনেক ইসু্যুতে সমাধান না এলেও প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরের অর্জন অনেক।
প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরে বাণিজ্যসংক্রান্ত চুক্তি সেপা (কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট) এগিয়ে নিতে দুই পক্ষ সম্মত হওয়া ছাড়াও উভয় দেশের মধ্যে কুশিয়ারা নদীর পানিবণ্টনে সমঝোতা হয়েছে। এ ছাড়া ভারত বাংলাদেশকে তৃতীয় দেশে পোশাক পণ্যসহ অন্যান্য পণ্য রপ্তানিতে মাল্টিমোডাল কানেকটিভিটির প্রস্তাব দিয়েছে, যা ছিল শেখ হাসিনার এবারের সফরের অন্যতম অর্জন। তৃতীয় দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট কিছু স্থল, বিমান ও সমুদ্রবন্দর বিনা ট্রানজিট ফিতে ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশকে প্রস্তাব দিয়েছে ভারত। যা বাংলাদেশের বহুল প্রত্যাশিত ছিল। সফরে এটিও অন্যতম অর্জন। যদিও বাংলাদেশের প্রত্যাশা ছিল তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি, সীমান্ত হত্যা বন্ধ ও নিত্যপণ্যের চাহিদা পূরণ, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ভারতের সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার। এর মধ্যে সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা এবং রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে রুটিন প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেলেও তিস্তার জট এবারেও খোলেনি। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর সফরে যে সাত স্মারক সই হয়েছে তা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বহুমাত্রিকতা প্রমাণ করে। বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে এ সফরে যে অগ্রগতি হয়েছে তা ইতিবাচক।
বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী দিল্লিতে শীর্ষ বৈঠকে বসেন গত মঙ্গলবার। বৈঠক শেষে দুই প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন তাদের আলোচনায় মতৈক্য হওয়া বিষয়গুলো। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রাপ্তির তালিকায় রয়েছে কুশিয়ারা নদীর ১৫৩ কিউসেক পানি প্রত্যাহার, জ্বালানি সহায়তা, খাদ্যপণ্য আমদানি। আর ভারতের প্রাপ্তির তালিকায় রয়েছে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার, ফেনী নদীর পানিবণ্টন। এবারের সফর নিয়ে প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে ভারত জানিয়েছে, দেশটির সব বন্দর, সড়ক, নৌপথ ব্যবহার করে বিনা মাশুলে তৃতীয় কোনো দেশে পণ্য রপ্তানি করতে পারবে বাংলাদেশ। বিষয়টি ছিল বাংলাদেশের জন্য বহুল কাক্সিক্ষত। আঞ্চলিক ও উপআঞ্চলিক ট্রান্সশিপমেন্ট ও ট্রানজিটের ভারতীয় এ প্রস্তাবকে বাংলাদেশের জন্য বড় প্রাপ্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর বাইরে ভারত বাংলাদেশকে তৃতীয় দেশে পোশাক পণ্যসহ অন্যান্য পণ্য রপ্তানিতে মাল্টিমোডাল কানেকটিভিটির প্রস্তাব দিয়েছে, যা দুই দেশের রেল মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হবে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ থেকে প্রথমে ট্রাকে করে ভারতে প্রবেশ করবে রপ্তানি পণ্য। এর পর ট্রেনে করে তা যাবে সমুদ্রবন্দরে। সেখান থেকে জাহাজে করে পণ্য যাবে ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রের বন্দরে।
এবারের সফরে আঞ্চলিক সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য বন্ধুত্ব ও অংশীদারত্বের চেতনায় বৃহত্তর সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা, প্রতিরক্ষা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য ও সংযোগ, পানিসম্পদ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, উন্নয়ন সহযোগিতা, সাংস্কৃতিক ও জনগণের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগসহ দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। তারা পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন, সাইবার নিরাপত্তা, আইসিটি, মহাকাশ প্রযুক্তি, পরিবেশসম্মত জ্বালানি এবং সুনীল অর্থনীতির মতো সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্রগুলোতে সহযোগিতা করতে সম্মত হন। এ ছাড়া দুই নেতা আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব এবং সরবরাহ শৃঙ্খলে বাধার কথা মাথায় রেখে নেতারা এ অঞ্চলের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য বন্ধুত্ব ও অংশীদারত্বের চেতনায় বৃহত্তর সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
শেখ হাসিনা এবং নরেন্দ্র মোদি দ্বিপক্ষীয় এবং উপআঞ্চলিক রেল, সড়ক এবং অন্যান্য সংযোগ উদ্যোগ বাস্তবায়নের গুরুত্বের ওপর জোর দেন। উভয় পক্ষই চলমান দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগগুলোকে স্বাগত জানিয়েছে। এ ছাড়া দুই দেশ দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন সহযোগিতার অধীনে বিভিন্ন অর্থায়ন ব্যবস্থার মাধ্যমে এ প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন অন্বেষণ করতে সম্মত হয়েছে।
দুই নেতা দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির প্রশংসা করেন, যেখানে ভারত এশিয়ায় বাংলাদেশের জন্য বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বাংলাদেশ ভারত থেকে চাল, গম, চিনি, পেঁয়াজ, আদা এবং রসুনের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের অনুমানযোগ্য সরবরাহের জন্য দিল্লিকে অনুরোধ জানিয়েছে। ভারতের পক্ষ থেকে জানানো হয়ে, তাদের বিদ্যমান সরবরাহের অবস্থার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের অনুরোধগুলো অনুকূলভাবে বিবেচনা করা হবে এবং এ বিষয়ে সব ধরনের প্রয়াস চালানো হবে।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে শান্তিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা একটি অভিন্ন অগ্রাধিকার। তা স্বীকার করে শান্ত ও অপরাধমুক্ত সীমান্ত বজায় রাখার লক্ষ্যে দুই নেতা কর্মকর্তাদের ত্রিপুরায় বেড়া নির্মাণসহ জিরো লাইনের ১৫০ গজের মধ্যে মুলতবি থাকা সব উন্নয়নমূলক কাজগুলো দ্রুত সম্পন্নের নির্দেশ দেন। পূর্বের আলোচনার কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিস্তা নদীর পানিবণ্টন সংক্রান্ত অন্তবর্তী চুক্তি করার জন্য বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের অনুরোধ পুনর্ব্যক্ত করেন, যার খসড়া ২০১১ সালে চূড়ান্ত করা হয়েছিল। উভয় নেতা নদীগুলোর দূষণ এবং অভিন্ন নদ-নদীর ক্ষেত্রে নদীর পরিবেশ এবং নদীর নাব্যতা উন্নত করার মতো সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্য কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। উপ আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ানোর চেতনায় দুই নেতা কাটিহার (বিহার) থেকে বাংলাদেশের পার্বতীপুর হয়ে বোরনগর (আসাম) পর্যন্ত প্রস্তাবিত উচ্চ ক্ষমতার ৭৬৫ কেভি ট্রান্সমিশন লাইনসহ দুই দেশের পাওয়ার গ্রিডগুলোকে একযোগে সংযুক্ত করার প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়নে সম্মত হন। উভয় দেশ বিদ্যুৎ খাতে উপ আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করতে সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতের মাধ্যমে নেপাল ও ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির অনুরোধ জানানো হয়। ভারতীয় পক্ষ জানিয়েছে, এর জন্য নির্দেশিকা ভারতে বিবেচনাধীন রয়েছে।
দুই নেতা ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন সংক্রান্ত অগ্রগতি পর্যালোচনা করেন, যা বাংলাদেশের জ্বালানি চাহিদা পূরণে অবদান রাখবে। তারা দ্রুত প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশ তরল জ্বালানি পণ্যের জন্য তার অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে সহায়তা করার জন্য ভারতকেও অনুরোধ করেছে। ভারত উভয়পক্ষের অনুমোদিত সংস্থাগুলোর মধ্যে আলোচনা করতে সম্মত হয়েছে। উভয় নেতা উন্নয়ন অংশীদারত্বের ক্ষেত্রে দুই পক্ষের মধ্যে জোরদার সহযোগিতার পরিপ্রেক্ষিতে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘যখন দুই বন্ধুপ্রতিম দেশের প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে বসেন তখন অনেক বিষয় আলোচনা হয়। আমরা জানি, জ্বালানি সংকট থেকে শুরু করে নিষেধাজ্ঞা, বাণিজ্যে পেমেন্ট, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক এগুলো শীর্ষ বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। এ আলোচনা থেকে দুই পক্ষ যেসব বিষয়ে সম্মত হয়েছে, তা আমাদের আরও পর্যবেক্ষণ করতে হবে। রোহিঙ্গা, তিস্তা ইস্যুতেও আলোচনা হয়েছে, এটাই গুরুত্বপূর্ণ। এসব ইস্যুতে চুক্তি না হলেও আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি, ইস্যু সমাধানের জন্য দুই পক্ষকে আরও উদ্ভাবনী চিন্তাশক্তি ব্যবহার করতে হবে। চীন, ভারত, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ বহুপক্ষীয় সহযোগিতার মাধ্যমে এসব অমীমাংসিত ইস্যু সমাধান করা সম্ভব।’ সীমান্ত হত্যা সম্পর্কে ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে সোনালী অধ্যায় চলমান। কিন্তু সীমান্তে হত্যা বন্ধ হচ্ছে না, এটা দুঃখজনক। তবে সহযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে এগোলে সব ইস্যুর সমাধান সম্ভব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘অর্জন শুধু চুক্তি বা সমঝোতা দিয়ে হয় না। দুই প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ হওয়াটাই একটা অর্জন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভাষায় দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন একসঙ্গে বসেন তখন দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন ইস্যু চলে আসে। তখন এ দ্বিপাক্ষিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা, এক ধরনের বোঝাপড়া এবং একটা আন্তরিক পরিবেশ তৈরি হয়, যেটা ভবিষ্যতে আরও বড় বড় সম্ভাবনা তৈরি করে। রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশ যে শঙ্কিত সেটা কিন্তু আগে থেকেই জানানো হয়েছিল। এটা নিয়ে এবারের সফরে বড় কোনো অর্জনের সম্ভাবনা ছিল না। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক বিষয় জড়িত আছে। তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে ভারত সহযোগিতা করবে এমন একটি আশ্বাস দিয়েছে। এগুলো চলমান প্রক্রিয়া। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যখন দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করে তখন এগুলো উঠে আসে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমাদের যে সামগ্রিক কূটনৈতিক প্রয়াস, তার অংশ হিসেবে এ বিষয়টিও আলোচনায় এসেছে। ভারতের অবস্থান থেকে তারা সহায়তা করবে; কিন্তু আমরা জানি রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত, চীন এবং আসিয়ান দেশগুলোর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তার পরও চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।