প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর পেয়ে জীবন বদল

জীবন সচ্ছল হয়েছে তাদের, এখন স্বপ্ন দেখেন সন্তানদের ভবিষ্যৎ

কক্সবাজার সংবাদদাতা
  ১১ জুন ২০২৪, ১৩:২৬

‘আগে ভাড়া বাসায় থাকতাম। এখন নিজের ঘরে নিজের মতো বসবাস করছি। অভাবের সংসার ছিল। তবে ঘরে সব রকমের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। মেয়েরা পড়াশোনা করে চাকরি করতে চায়। আল্লাহ দিলে ভবিষ্যতে আর অভাব থাকবে না।’ আবেগাপ্লুত হয়ে কথাগুলো বলছেন আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর পাওয়া জাহেদা আক্তার (৩৮)।
তার স্বামী মোহাম্মদ ইউনুস পেশায় রাজমিস্ত্রি। তাদের তিন মেয়ের বড় মেয়ে ইশরাত শাহিদা পিংকি ডিগ্রি পাস করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। মেজ মেয়ে এইচএসসি প্রথম বর্ষে পড়ছে, আর ছোট মেয়ে পড়ছে অষ্টম শ্রেণিতে।
শুধু জাহেদা আক্তার নন, আরও অনেকের জীবনই পাল্টেছে প্রধানমন্ত্রীর এই প্রকল্পের ঘর পেয়ে। একসময় দৈনন্দিন খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হতো তাদের। ছিলেন ভূমিহীন-গৃহহীন। ভাড়া বাসায় বা অন্যের বাড়িতে আশ্রিত থেকেছেন। জমি কিনে ঘর তৈরি করবেন, এমনটা চিন্তাও করতে পারেননি কখনও। এখন নিজের একখণ্ড জমি হয়েছে, সঙ্গে আধাপাকা ঘর পেয়েছেন বিনামূল্যে। আছে বিদ্যুৎ-সংযোগ ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা।


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের আশ্রয়ণ প্রকল্পে স্থায়ী ঠিকানা পাওয়ায় কক্সবাজারের উখিয়ায় সচ্ছল জীবনযাপনের সাধ পাচ্ছেন অনেক ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবার। ফলে এখন তাদের চোখে স্বপ্ন, সন্তানদের মানুষ করবেন, বাকি জীবন কাটাবেন সুখে।
সারা দেশের মতো কক্সবাজারের উখিয়া রাজাপালং লম্বাঘোনা টিএন্ডটি আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই হয়েছে ৮৮টি পরিবারের। সরেজমিনে সেখানে দেখা যায়, সুবিধাভোগীদের মুখে প্রশান্তির হাসি। পরিবারগুলো সন্তানদের নিয়ে সুখেই আছে। তাদের সন্তানরা পড়াশোনা করছে। তারা শিক্ষিত হয়ে মানুষ হবে, চাকরি করবে, সেই স্বপ্ন দেখছেন অভিভাবকরা।
আশ্রয়ণ প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা জানান, এক-একটি পরিবারের জন্য ২ শতাংশ জমিসহ আধাপাকা ঘরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বরাদ্দের ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর যৌথ নামে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। এতে সরকার নারীর ক্ষমতায়ন, সামাজিক নিরাপত্তা, গ্রামেই শহরের সুযোগ-সুবিধা, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে মানবসম্পদ ও পরিবেশ উন্নয়নের মাধ্যমে পুনর্বাসিত মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছে। প্রথম পর্যায় থেকে পঞ্চম পর্যায় পর্যন্ত নির্মিত সব ঘরের গুণগত মান বজায় রাখার জন্য ধারাবাহিক প্রচেষ্টাও চালানো হয়েছে।
আশ্রয়ণ কেন্দ্রের তৃতীয় সারিতে ঘরে বসবাস করেন রত্নাধর (৫২)। তার তিন ছেলে ও এক মেয়ে। ২৭ বছর আগে স্বামী পরিত্যক্তা হলে তখন ভেঙে পড়েন। দীর্ঘদিন উখিয়ায় একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন তারা।
রত্নাধর জানান, পাঁচ হাজার টাকা ঋণ করে একটি ছাগল পালন শুরু করেন। এখন ছোট-বড় ১০টি ছাগল রয়েছে; যার বাজার মূল্য ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। বাড়ির আশপাশে শাকসবজি চাষ করছেন, ছোট ছেলে দোকান চালান। সবাইকে নিয়ে ভালোই চলে যাচ্ছে দিন।
৭২ বছর বসয়ী সোনাকান্তি দাস দুই ছেলে, দুই মেয়ের জনক। বড় ছেলে এনজিওতে চাকরি করেন আর ছোট ছেলে চাকরি করেন বেকারিতে। উখিয়া শহরে বাসা ভাড়া করে থাকতেন অনেক কষ্ট করে।
সোনাকান্তি দাস বলেন, ২০২২ সালে এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর পেয়েছি। এক ছেলে এখন আমার সঙ্গে থাকে। আরেক ছেলে উখিয়ায় বাসা ভাড়া করে থাকে, তাদের সঙ্গে আমার স্ত্রী থাকেন। নাতি-নাতনিরা পড়াশোনা করছে। ওরা একদিন সবার মুখে হাসি ফোটাবে।
সুখা বড়ুয়া নামের স্বামী পরিত্যক্তা এক নারী বলেন, আমি এসএসসি পাস। দুই বাচ্চা নিয়ে অসহায় অবস্থায় বাবার কাছে আশ্রিত ছিলাম। এখন আশ্রয়ণ প্রকল্পে একটা ঘর পেয়েছি। এটাই আমার স্থায়ী ঠিকানা।
ঘর পেয়ে তাদের আত্মসম্মান আর আত্মমর্যাদা বেড়েছে
তিনি আরও বলেন, ১০ টাকায় কলমি শাক কিনে চাষ শুরু করেছিলাম। পরে ২০ কেজি হলুদ চাষ করি। তাতে কাঁচা হলুদ পেয়েছি চার মণ। এখন শাকসবজি ও তরকারি বিক্রি করি। প্রতিদিন বিক্রি হয় ৭০০ টাকার। তাতে যে লাভ হয়, তা দিয়ে সংসার ভালো চলছে।
স্বামী হাত ছেড়ে দিলেও রাবেয়া বেগম (৩৫) ২৫ বছর ধরে সেলাই মেশিন চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তিনি বলেন, আগে অনেক খারাপ অবস্থা ছিল, এখন বাচ্চাদের নিয়ে একটা ঘরে থাকতে পারি। নিজের একটু জায়গা হয়েছে আশ্রয়ণ প্রকল্পে। মাসে আয় ১০ হাজার টাকা আয় হয়। আমার তিন মেয়ে। বড় মেয়ে কক্সবাজার সরকারি কলেজে অনার্স পাস করছে। মেজ মেয়ে সায়মা অনার্সে পড়ে।
রাবেয়ার মেয়ে সায়মা বলেন, মাকে নিয়ে নানার বাড়িতে ছিলাম, ছোট ঘরে থাকতে আমাদের অনেক সমস্যা হতো। এখন মা একটি ঘর পেয়েছেন। নিজেদের ঘরেই এখন আমরা থাকি। পড়াশোনা শেষ করে ভালো একটি চাকরি করার স্বপ্ন দেখি।
কক্সবাজার জেলার ঈদগাও উপজেলার দর্গাপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে সুবিধাবোগীদের একজন আসমা আক্তার। মাত্র তেইশ বছরের এই নারী স্বামী পরিত্যক্তা হয়েছেন কয়েক বছর আগে। বাবার বাড়িতে ঠাঁই হয়েছিল তার। আসমা বলেন, অল্প বয়সেই স্বামী ছেড়ে গেছে আমাকে। একটি মেয়ে নিয়ে আমার ছোট একটি সংসার। মেয়েকে মানুষ করতে চাই, সে জন্য উপার্জন দরকার। সেলাই মেশিন চালিয়ে আয়-রোজগার করে ভালোভাবে জীবন যাপন করার স্বপ্ন দেখছি আমি।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৮৮টি ঘর রয়েছে। উপহার হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে এই ঘরগুলো উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছে তাদের। যারা এই উপহারের ঘর পেয়েছেন, তাদের জীবনে উন্নয়ন ঘটেছে। তাদের আত্মসম্মান আর আত্মমর্যাদা বেড়েছে।
সম্প্রতি পঞ্চম পর্যায়ের দ্বিতীয় ধাপে কক্সবাজার জেলার সদর উপজেলায় ৭৫টি, ঈদগাও উপজেলায় ১৪৬টি এবং মহেশখালী উপজেলায় ৪০টি, সর্বমোট ২৬১টি গৃহের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এগুলো নির্বাচিত উপকারভোগীদের মাঝে মঙ্গলবার (১১ জুন) হস্তান্তর করা হবে। কক্সবাজার সদর, ঈদগাও ও মহেশখালী উপজেলায় আর কোনও ভূমিহীন পরিবার না থাকায় ভূমিহীন-গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করা হচ্ছে।
নির্মিত প্রতিটি ঘরের সঙ্গে পরিবার প্রতি ২ শতাংশ খাসজমি বিনামূল্যে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে, সে হিসাবে এখন পর্যন্ত ৯৮ দশমিক ৫০ একর খাসজমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য ১০০ কোটি টাকারও বেশি। এ ছাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পগুলোয় প্রায় ২২ একর জমি কমন স্পেস হিসেবে উপকারভোগীরা ব্যবহার করছেন।
এর বাইরে ১ হাজার ৬০৪ জন উপকারভোগীর মাঝে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ (হাঁস-মুরগি পালন, গরু মোটাতাজাকরণ, মাছ চাষ, সবজি চাষ, অর্গানিক সবজি উৎপাদন, সেলাই ও ব্লক বাটিক প্রশিক্ষণ, কারিগরি প্রশিক্ষণ, হস্তশিল্প বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রভৃতি) প্রদান করা হয়েছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘মুজিববর্ষে বাংলাদেশের একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না’। সে মোতাবেক কক্সবাজারকে ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত ঘোষণার চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। কক্সবাজারের ৯টি উপজেলায় ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৯২৫।
আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ১ম, ২য়, ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম পর্যায়ে (১ম ধাপ) পর্যন্ত ৪ হাজার ৬৬৪টি পরিবারের মধ্যে গৃহনির্মাণ করে হস্তান্তর করা হয়েছে। এই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে কক্সবাজারের ছয়টি উপজেলা চকরিয়া, পেকুয়া, রামু, উখিয়া, টেকনাফ, কুতুবদিয়াকে ভূমিহীন-গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।