বাংলাদেশে উন্নয়ন সহযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গেছে চীন। বাংলাদেশের পঞ্চম শীর্ষ ঋণদাতা এখন চীন। গত অর্থবছরে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ছাড়িয়েছে এক হাজার ৩৬৮ কোটি ডলার। দেশের মোট আমদানির প্রায় ২৫ শতাংশ জোগান দিচ্ছে চীন।
বৈদেশিক ঋণ, অনুদান ও সহায়তা প্রাপ্তিতে বাংলাদেশ মূলত বিশ্বব্যাংক, জাপান ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ওপর বেশি নির্ভরশীল। এর বাইরে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, এক দশক আগেও ঋণ, অনুদান ও সহায়তা প্রদানের তালিকায় নিচের সারিতে ছিল চীন। গত পাঁচ অর্থবছরে চীনের কাছ থেকে বৈদেশিক সহায়তা কয়েক গুণ বেড়েছে। ফলে চীন এখন শীর্ষ পাঁচে উঠে এসেছে।
শীর্ষ দেশ হিসেবে ২০২০-২১ অর্থবছরে জাপানের ঋণ ছাড়করণের পরিমাণ ছিল ১৯২ কোটি ৬৩ লাখ ৫৫ হাজার ডলার। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বিশ্বব্যাংক। বহুপাক্ষিক সংস্থা হিসেবে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে বাংলাদেশ ঋণ পেয়েছে ১৫৭ কোটি ৬৯ লাখ ৬৭ হাজার ডলার। এডিবির ছাড় করা ঋণের পরিমাণ ১২৬ কোটি ১৭ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা, যা তৃতীয় সর্বোচ্চ। চতুর্থ শীর্ষ দেশ রাশিয়ার ঋণ ছাড়করণের পরিমাণ ১০২ কোটি ৯৫ লাখ ৫৬ হাজার ডলার।
পঞ্চম শীর্ষ দেশ চীন থেকে ঋণের ছাড়করণ হয়েছে ৮৮ কোটি ৭৯ লাখ ৯২ হাজার ডলার। মূলত দেশের বৃহৎ কয়েকটি অবকাঠামোতে ঋণ ও অর্থ সহায়তার কারণে চীনের এই উন্নতি হয়েছে। এ ছাড়া পাইপলাইনে চীনের অর্থায়নের যে পরিমাণ রয়েছে তাতে স্বল্প সময়ে দেশটি শীর্ষ চারে উঠে আসতে পারে।
শীর্ষ বৈদেশিক সহায়তাকারী :
ইআরডির তথ্য বলছে, আগামী কয়েক বছরে চীনের যে পরিমাণ বৈদেশিক সহায়তা ছাড় করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তাতে স্বল্প সময়ে শীর্ষ চারে উঠে আসার সম্ভাবনা রয়েছে দেশটির। গত ৫০ বছরে বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে আইডিএ মোট বৈদেশিক (ঋণ, অনুদান ও এইড) সহায়তা দিয়েছে দুই হাজার ৪৯৭ কোটি ১৫ লাখ ডলার।
এরপরই এডিবির এক হাজার ৭৯৫ কোটি ২৫ লাখ ডলার, জাপানের এক হাজার ৬১৮ কোটি ৯২ লাখ ডলার এবং রাশিয়ার ৪৪৪ কোটি ১৯ লাখ ডলার। এই তালিকায় চীনের ১৩৮ কোটি ৪৮ লাখ এবং জাতিসংঘের সংস্থাগুলো ৪১৮ কোটি ৫৮ লাখ ডলার বৈদেশিক সহায়তা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বৈদেশিক সহায়তার পরিমাণ যথাক্রমে ৩৫৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার এবং ২৭২ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
সম্প্রতি চীন ও বাংলাদেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণা করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান র্যাপিড। র্যাপিডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক বলেন, পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে বিভিন্ন দেশে অর্থলগ্নি ও সহায়তা বিষয়ে চীনের নিজস্ব কৌশল রয়েছে। বাংলাদেশের অবকাঠামো, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়নে চীনের ঋণ ও অর্থায়ন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মাধ্যমে ঋণ চাহিদা ও বৈদেশিক সহায়তায় বৈচিত্র্য এসেছে।
আবদুর রাজ্জাক বলেন, তবে চীনের ঋণজনিত সংকট কাটাতে হলে অবশ্যই ঋণের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে ঋণ ও অর্থ সহায়তা গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা, বিশেষ গ্রেস পিরিয়ড ও ম্যাচুরিটির সময়, সুদের হারসহ শর্তগুলো ভালোভাবে যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বৈদেশিক সহায়তা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে না পারলে দেশের জন্য ঝুঁকি তৈরি হবে। বৈদেশিক ঋণ নিয়ে উন্নয়ন প্রকল্পের অগ্রাধিকার খাত ঠিক করতে না পারা, প্রকল্পের ব্যয় যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করতে না পারলে এসব অবকাঠামো থেকে ভবিষ্যতে আয় (আইআরআর) কমে যাবে।
বাণিজ্য : চীনের সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে দুই ধরনের তথ্য রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য এক হাজার ৩৬৮ কোটি ডলারের। চীনের তথ্য বলছে, বাংলাদেশ ও চীনের বাণিজ্য ছাড়িয়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি ডলার।
বাংলাদেশের সরকারের তথ্য মতে, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে চীন থেকে বাংলাদেশ আমদানি করেছে প্রায় এক হাজার ৩০০ কোটি ডলারের পণ্য, যা দেশের মোট আমদানির প্রায় ২৫ শতাংশ। বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৬৮ কোটি ডলার। চীনের পক্ষ থেকে বেশ কিছু সুবিধা দেওয়ার পরও দেশটিতে রপ্তানি বৃদ্ধি করা যাচ্ছে না।
২০২০ সালে ৯৭ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতায় আট হাজার ৫৪৭টি পণ্য চীনে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পাচ্ছে। এটি আগে মাত্র ৬১ শতাংশ ছিল। ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে আরো ৩৮৩টি পণ্যের শুল্কমুক্ত সবিধা বাড়ানোর মাধ্যমে এখন দেশটিতে মোট শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতায় এসেছে আট হাজার ৯৩০ পণ্য।
মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক বলেন, কভিড-পরবর্তী সময়ে চীনের বাণিজ্যনীতিতে বড় পরিবর্তন এসেছে। আমদানি পণ্যের উৎস্য চীন অনেক দেশের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়াচ্ছে। সেই নীতির সুবিধা বাংলাদেশকে নিতে হবে। তিনি বলেন, এ ছাড়া বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য আরএমজি নির্ভরতা থেকে বের হয়ে আইসিটি ও আইটিএস, ইলেকট্রিক্যাল ইকুইপমেন্ট ও ইলেকট্রনিকস পণ্য রপ্তানি বাড়ানোয় নজর দিতে হবে। শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা বাড়াতে হলে দেশ দুটির ব্যবসায়ী পর্যায়ে আরো দক্ষতা বাড়াতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির যুগ্ম মহাসচিব আল মামুন মৃধা বলেন, বাংলাদেশের পণ্য চীনে রপ্তানি করার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত ও বিকল্প বাজার হতে পারে। কারণ দেশটিতে ১০০টি শহর রয়েছে, যেখানে প্রতিটি শহরের জনসংখ্যা এক কোটির বেশি। শিগগিরই চীন আমেরিকার চেয়ে বড় খুচরা বাজারে পরিণত হবে। তিনি বলেন, ৭০ কোটির বেশি অনলাইন ভোক্তা রয়েছে চীনে। দেশটিতে রপ্তানি বাড়াতে আমাদের তাইওয়ান, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও জাপানের মতো দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। যোগাযোগ ও ভাষাগত বাধা দূর করতে চীনে রপ্তানিকারক দেশগুলোর জন্য একটি অফিস বা কান্ট্রি প্যাভিলিয়ন থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য সেটি এখনো করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে কাজ হচ্ছে।