আসামি বিএনপি-জামায়াতের, গ্রেপ্তার হচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতারা!

পুলিশের দায়ের করা ৩৪ হত্যা মামলা নিয়ে প্রশ্ন

ডেস্ক রিপোর্ট
  ২৬ আগস্ট ২০২৪, ১৪:২৯

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে হামলা-সংঘাতে নিহত হওয়ার ঘটনায় শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে করা পুলিশের করা মামলাগুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ৫ আগস্টের আগে ৬৪ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন থানায় পুলিশ ৩৪টি মামলা করেছে। তাতে আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাতনামা বিএনপি, জামায়াত ও কোটা আন্দোলনকারীদের। একই সময়ে স্বজনদের বাদী করে আরও তিনটি হত্যা মামলা হয়, তাতেও একই রকম আসামি করা হয়।

বিএনপি, জামায়াত ও কোটা আন্দোলনকারীদের আসামি করা সেসব মামলায় এখন আওয়ামী লীগের নেতা, সাবেক মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে। আইনজীবীদের মতে, এমন অসংগতি পুরো মামলাকেই দুর্বল করে দেবে।
এসব মামলার এজাহারের বর্ণনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নিহতদের স্বজনেরাও। পুলিশের গুলিতে মারা যাওয়ার ঘটনায়ও অজ্ঞাতনামা বিএনপি, জামায়াত ও কোটা আন্দোলনকারীরা জড়িত বলে উল্লেখ করার কথা পরে জানতে পেরে তাঁরা বিস্মিত হয়েছেন। তাঁদের দাবি, তাঁরা এমন এজাহার দেননি। পুলিশ মনগড়া এজাহার দিয়েছে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে পুলিশের করা ৩৪ মামলায় আসামি করা হয় বিএনপি-জামায়াত ও আন্দোলনকারীদের।  
এখন বাদীদের কেউ কেউ থানায় গিয়ে নতুন করে এজাহার দিচ্ছেন। তাতে সাবেক মন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের নেতা ও পুলিশকে আসামি করা হচ্ছে। তবে পুলিশ বলছে, একই ঘটনায় দুটি মামলা করার আইনি সুযোগ নেই। তাই নতুন করে দেওয়া অভিযোগ আগের মামলার নথিতে সংযুক্ত করা হচ্ছে।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, এজাহারে যদি উল্লেখ থাকে যে খুনের ঘটনায় বিএনপি-জামায়াত ও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা জড়িত, সেই মামলায় আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেপ্তার দেখানো কেবল হাস্যকর নয়; এটা আইনত ভুল। তাঁর মতে, স্বাভাবিক সময়ে যদি এটা কেউ করতেন, তাঁর চাকরি থাকার কথা নয়। কাউকে হুট করে একটা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো যায় না। গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কারণ লাগে।
১৭ জুলাই থেকে ১ আগস্ট পর্যন্ত পুলিশ বাদী হয়ে করা ৩৪ মামলার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মামলাগুলোর এজাহারের শেষাংশে বর্ণনা প্রায় একই রকম। তাতে বলা হয়, বিএনপি ও জামায়াত এবং তাদের অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ নেতাদের নির্দেশে সন্ত্রাসী অথবা দুষ্কৃতকারীরা আগ্নেয়াস্ত্র, বিস্ফোরক দ্রব্য ও মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পুলিশকে আক্রমণ করে। নিহতের ঘটনা ঘটেছে কোটাবিরোধী আন্দোলনের আড়ালে থাকা সন্ত্রাসী বা দুষ্কৃতকারীদের গুলিতে।
আসামি বিএনপি-জামায়াত, গ্রেপ্তার আ.লীগ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে প্রথম মানুষ নিহত হন ১৬ জুলাই। ওই দিন কেবল নিউমার্কেট এলাকায় দুজন নিহত হন। তাঁদের একজন হকার শাহজাহান আলী। তাঁর মা আয়েশা বেগমকে বাদী করে নিউমার্কেট থানায় ১৭ জুলাই হত্যা মামলা হয়। ওই মামলায় ১৪ আগস্ট গ্রেপ্তার দেখানো হয় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও প্রধানমন্ত্রীর সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে। একই মামলায় ১৭ আগস্ট গ্রেপ্তার দেখানো হয় সেনাবাহিনী থেকে সদ্য অব্যাহতি পাওয়া মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে। তিনজনকেই এ মামলায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ।
অথচ শাহজাহান আলী হত্যা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, কোটাবিরোধী অজ্ঞাতনামা আন্দোলনকারীরা, জামায়াত-শিবির ও বিএনপির সশস্ত্র আসামিরা এক হয়ে অতর্কিতভাবে হকার শাহজাহান আলীর ওপর আক্রমণ করে। গুরুতর জখম অবস্থায় শাহজাহান আলীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
তবে এ মামলায় আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমানকে রিমান্ডে নেওয়ার তিন দিন পর ১৭ আগস্ট আদালতে একটি সংশোধনী এজাহার জমা দেয় নিউমার্কেট থানা-পুলিশ। তাতে বলা হয়, মামলার বাদী আয়েশা বেগম পুত্রশোকে কাতর ছিলেন। যে কারণে আগে তাঁর দায়ের করা মামলার এজাহারে ভুলবশত আসামি হিসেবে বিএনপি, জামায়াত ও শিবিরের নাম উল্লেখ করেছেন। পরে তিনি মামলার আসামি হিসেবে অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারীদের কথা উল্লেখ করে সংশোধিত এজাহার দিয়েছেন। তাতে বলেছেন, তাঁর ছেলে শাহজাহান আলী অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারীদের আক্রমণে রক্তাক্ত জখম হয়। দুষ্কৃতকারীদের গুলিতে তাঁর নাকের ডান পাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে আয়েশা বেগম ১৯ আগস্ট  বলেন, তাঁর ছেলেকে সরকারি লোকজন গুলি করে মেরেছে। কখনো তিনি বলেননি, তাঁর ছেলের হত্যায় বিএনপি, জামায়াত কিংবা কোটাবিরোধীরা জড়িত। তিনি এমন অভিযোগে কোনো এজাহারও দেননি।
নিউমার্কেট থানার উপপরিদর্শক সজীব মিয়া
আয়েশার স্বামী ইমাম হোসেনের ভাষ্য, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গ্রেপ্তার হওয়ার পর মামলার এজাহারের অনুলিপি সংগ্রহ করার পর জানতে পারেন, আসামির তালিকায় বিএনপি-জামায়াতের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তখন তিনি পুলিশের কাছে জানতে চান, মামলায় বিএনপি-জামায়াতের নাম কীভাবে এল। পরে অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারীদের নাম উল্লেখ করে আয়েশা সংশোধিত এজাহার জমা দেন বলে জানান ইমাম হোসেন।
মামলায় আসামি করা হয় বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীদের। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাদের কেন গ্রেপ্তার করা হলো—জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা নিউমার্কেট থানার উপপরিদর্শক সজীব মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলায় যা-ই থাকুক, তদন্তে পেয়েছি বলে সাবেক আইনমন্ত্রীসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছি।’
এই তিনজনকে গত শনিবার নিউমার্কেট থানার সবুজ আলী হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। ছাত্রলীগের কর্মী ঢাকা কলেজের ছাত্র সবুজ আলীর প্রথম জানাজা হয় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে। তাতে দলটির নেতা-কর্মীরা অংশ নেন।
তবে গত শনিবার এ মামলায় আদালতে দেওয়া রিমান্ডের আবেদনে পুলিশ বলেছে, সবুজ আলী হত্যাকাণ্ডে উসকানিদাতা ও হুকুমদাতা ছিলেন আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান ও জিয়াউল আহসান।
ফৌজদারি আইনজ্ঞ এহসানুল হক সমাজী  বলেন, এজাহারে যদি ঘটনার সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত ও কোটাবিরোধীরা জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়, আর গ্রেপ্তার করা হয় আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের; তাতে মামলার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। এর আইনগত সুবিধা পাবেন গ্রেপ্তারকৃতরা।
এক ঘটনায় দুই এজাহার  
১৯ জুলাই পল্টন এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান রিকশাচালক কামাল মিয়া। এ ঘটনায় পরদিন পল্টন থানায় মামলা হয়। এ মামলায় ১৫ আগস্ট গ্রেপ্তার করা হয় ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক (টুকু), সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী জুনায়েদ আহ্‌মেদ পলক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ শাখার সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতকে।
যদিও এ মামলায় আসামি করা হয় অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারীদের। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কামাল মিয়ার স্ত্রী ও মামলার বাদী ফাতেমা খাতুন বলেন, মামলার বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। স্বামীর লাশ বুঝে নেওয়ার সময় থানা-পুলিশ বিভিন্ন কাগজে সই নিয়েছেন। পরে তিনি জানতে পেরেছেন যে পুলিশের গুলিতে তাঁর স্বামী মারা গেছেন।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমেদ হোসেন ও সদ্য অব্যাহতি পাওয়া রিয়াল অ্যাডমিরাল মো. সোহাইলকে ২০ আগস্ট গ্রেপ্তার করা হয় পল্টন থানার আরেকটি মামলায়। মামলাটি হয়েছে ২০ জুলাই নবীন তালুকদার নামে এক মুদিদোকানি নিহত হওয়ার ঘটনায় করা মামলায়। প্রথম এজাহারে বলা হয়, পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের গুলিবিনিময়ের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান নবীন তালুকদার।
মামলার বাদী হলেন নবীনের স্ত্রী রুমা আক্তার। এ মামলার এক মাস পর ২০ আগস্ট থানায় আরেকটি এজাহার জমা পড়ে রুমা আক্তারের সই করা। এতে শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সাবেক আইজিপি, পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ ১৩ জনকে আসামি করা হয়।
দুটি এজাহারের বিষয়ে জানতে চাইলে রুমা আক্তার বলেন, প্রথম এজাহার সম্পর্কে তিনি কিছু জানতেন না। তবে স্বামীর মরদেহ নেওয়ার সময় পুলিশ বিভিন্ন কাগজে তাঁর সই নিয়েছে। পরে তিনি জেনেবুঝে এজাহার দিয়েছেন।
একই ঘটনায় দুটি মামলা হলো কি না, সে বিষয়ে জানতে চাইলে পল্টন থানার বর্তমান ওসি মোল্লা মো. খালিদ হোসেন বলেন, আগের ওসি কী করেছেন জানি না। এক ঘটনায় দুই মামলা নেওয়ার সুযোগ নেই। তাই দ্বিতীয় এজাহারটি মামলায় সংযুক্ত করা হয়েছে।
পুলিশের অদক্ষতা বা মনগড়া আচরণের কারণে এমনটা হচ্ছে বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক। তিনি বলেন, অতীতে হয়রানির উদ্দেশ্যে যেভাবে মামলায় জড়ানো হতো, এখনো সেই একই কাজ হচ্ছে। এর ফলে মামলাগুলো দুর্বল হয়ে যেতে পারে।
গুলিতে নিহত হয়েছেন, এমন পাঁচজনের স্বজন বলেছেন, পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন, আবার পুলিশই বাদী হয়ে মামলা করে অন্যদের আসামি করেছেন।
৩৪ মামলার কী হবে
এদিকে অজ্ঞাতনামা ‘বিএনপি, জামায়াত ও কোটাবিরোধীদের’ আসামি করে পুলিশ বাদী হয়ে যে ৩৪টি হত্যা মামলা করেছে; সেগুলোয় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি। জব্দ করা হচ্ছে না প্রয়োজনীয় আলামতও।
ফৌজদারি আইনজ্ঞরা বলছেন, একটি হত্যাকাণ্ড প্রমাণের জন্য পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ আদালতের সামনে হাজির করতে হয়। খুনের ঘটনা প্রমাণের জন্য প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী, পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যসহ প্রাসঙ্গিক সব ধরনের উপাদান প্রয়োজন হয়। আর হত্যাকাণ্ডের পরপরই ঘটনাস্থল পরিদর্শন, প্রয়োজনীয় নমুনা সংগ্রহ এবং ছবি ও ফুটেজ সংরক্ষণ জরুরি। পরে নমুনাগুলোর ফরেনসিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করা।
খুনসহ যেকোনো ফৌজদারি মামলার অভিযোগ প্রমাণের জন্য দরকার হয় প্রত্যক্ষদর্শী ও দালিলিক সাক্ষ্য। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে এতগুলো মানুষ মারা গেলেন, এসব ঘটনার বিস্তারিত তদন্ত হওয়া উচিত।
জ্যেষ্ঠ জেলা জজ সাইফুজ্জামান
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ২৫ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অন্তত ২৫টির বেশি হত্যা মামলা হয়েছে। এর বাইরে থানায়ও মামলা হচ্ছে। এসব মামলায় আওয়ামী লীগের নেতা, সাবেক মন্ত্রী, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন ব্যক্তিদের আসামি করা হচ্ছে।
অবসরে যাওয়া জ্যেষ্ঠ জেলা জজ সাইফুজ্জামান বলেন, খুনসহ যেকোনো ফৌজদারি মামলার অভিযোগ প্রমাণের জন্য দরকার হয় প্রত্যক্ষদর্শী ও দালিলিক সাক্ষ্য। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে এতগুলো মানুষ মারা গেলেন, এসব ঘটনার বিস্তারিত তদন্ত হওয়া উচিত। অন্যথায় নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের ক্ষোভ বাড়বে।

* প্রথম আলো থেকে নেওয়া