প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শুধু জমিয়ে রাখলে হবে না। সেটা কাজে লাগাতে হবে। যারা বলেছিল দেশ শ্রীলঙ্কা হবে, তাদের মুখে ছাই পড়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের পরনির্ভরশীল থাকলে হবে না। আত্মনির্ভরশীল হতে হবে। তাই আহ্বান জানাচ্ছি, এক ইঞ্চি জমি যেন অনাবাদি না থাকে। ’
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যুব মহাসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। যুবলীগ প্রতিষ্ঠার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে এ মহাসমাবেশ আয়োজন করা হয়। এতে ১০ লাখ মানুষ জমায়েত হয়েছে বলে জানান আয়োজকরা।
বিএনপির সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপির অনেক নেতা অর্থপাচার, লুটপাট ও দুর্নীতির কথা বলে। তারেক জিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই সাক্ষ্য দিয়ে গেছে। অর্থপাচার মামলায় সে সাত বছরের সাজাপ্রাপ্ত। অস্ত্র মামলারও আসামি। তাদের মুখে এই সমালোচনা মানায় না। ’
বিরোধীদের সমালোচনাকে গুরুত্ব না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ওরা যত কথাই বলুক, বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা এগিয়ে যাব। ’
যুবলীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্বে নিষেধাজ্ঞা-পাল্টানিষেধাজ্ঞা চলছে। ফলে বিশ্ববাজারে প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। আমাদের পরনির্ভরশীল থাকলে হবে না। আত্মনির্ভরশীল হতে হবে। ’ তিনি বলেন, ‘আমি যুবলীগের প্রত্যেক নেতাকর্মীকে বলব, সবাই গ্রামে যান। গ্রামে গিয়ে সেখানে কোনো জমি যেন অনাবাদি না থাকে, সেটা নিজেদের দেখতে হবে। নিজের জমি যেমন চাষ করতে হবে, অন্যের জমিতেও যাতে উত্পাদন হয়, সেই ব্যবস্থায় প্রত্যেক যুবলীগকর্মীকে কাজ করতে হবে। যখন সারা বিশ্বে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি, বাংলাদেশে ইনশাআল্লাহ কোনো দুর্ভিক্ষ হবে না। তার জন্য আমাদের এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। ’
যুবলীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে হাসিনা বলেন, ‘আমাদের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে যুবাদের একটা অবস্থান আছে। তাই বঙ্গবন্ধু যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই জাতির পিতা ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন এবং ৭ই মার্চের ভাষণ দেন। আজ এখানে বলতে চাই, আমি এই দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তুলতে চাই। তরুণরাই এতে নেতৃত্ব দেবে। ’
যুব মহাসমাবেশে সভাপতিত্ব করেন যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ। বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, জাহাঙ্গীর কবির নানক প্রমুখ।
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আইএমএফ জানে, শেখ হাসিনা সময়মতো ঋণ শোধ করে। সে জন্য ঋণ দিয়েছে। আমরা ঋণ নিয়েছি ঘি খাওয়ার জন্য নয়। বিএনপি যদি আবার ক্ষমতায় আসে, তাহলে বিদেশি ঋণ গিলে খাবে, গণতন্ত্র গিলে খাবে। সুযোগ পেলে বাংলাদেশও গিলে খাবে। ’
শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশে যেভাবে নির্বাচন হয় বাংলাদেশেও সেভাবে নির্বাচন হবে। খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। কারণ তাঁরা সাজাপ্রাপ্ত আসামি।
বিএনপির নেতাদের উদ্দেশে যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ বলেন, ‘আপনার নেতাকর্মীরা কি শেখ হাসিনার উন্নয়ন ব্যবহার থেকে বিরত থেকেছেন? পারেননি। শেখ হাসিনার উন্নয়ন উপেক্ষা করতে পারবেন না। আমি বলতে চাই, শেখ হাসিনার উন্নয়ন সবার জন্য। শেখ হাসিনার উন্নয়ন ব্যবহার করতে আপনারা বাধ্য। সড়কপথে এক্সপ্রেসওয়ে বা ছয় লেনের সড়কে গেলে সেটাও শেখ হাসিনার উন্নয়ন। ’
যারা বলেছিল দেশ শ্রীলঙ্কা হবে, তাদের মুখে ছাই পড়েছে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতি এখনো যথেষ্ট শক্তিশালী। অনেকেই চেয়েছিল দেশ শ্রীলঙ্কা হবে, এটা হবে, সেটা হবে, তাদের মুখে ছাই পড়েছে। সেটা হয় নাই, ইনশাআল্লাহ হবেও না। কিন্তু আমাদের কাজ করতে হবে। ’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের বাইরে থেকে সব খাবার, তেল আনতে হচ্ছে। তার ওপর দুইটা বছর আমাদের কোনো ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আসেনি। দুই বছর পর যখন সারা বিশ্ব উন্মুক্ত হয়েছে, তখন ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আসছে। আমাদের রিজার্ভ তো ব্যবহার করতেই হবে। তার মধ্যে আট বিলিয়ন আমরা আলাদাভাবে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করছি। কারণ শুধু রিজার্ভ জমিয়ে রাখলে তো হবে না। সেটাকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে। ’
চোখ থাকতে অন্ধ হলে উন্নয়ন দেখবে কী করে
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অনেকে নাকি আমাদের উন্নয়ন চোখে দেখে না। চোখ থাকতে যদি কেউ অন্ধ হয়, তাকে তো কিছু দেখানো যায় না। কিন্তু তারা তো ডিজিটাল বাংলাদেশ ব্যবহার করছে, মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে। সবই তো আওয়ামী লীগের দেওয়া। আওয়ামী লীগ সরকার এসে মোবাইল ফোন জনগণের হাতে তুলে দিয়েছে। ডিজিটাল ফোন আওয়ামী লীগ করেছে। সাড়ে আট হাজার ডিজিটাল সেন্টার আমরা করেছি। কত যুবকের যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। ’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপির আমলে কী করেছে? জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা জিয়া—সবার তো একই ইতিহাস। হাজার হাজার সৈনিক, অফিসার খুন হয়েছে। সেই সঙ্গে খুন হয়েছে আমাদের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। জিয়াউর রহমান সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতায় এসেছে। ’
কানাডার আদালত বলেছেন বিএনপি সন্ত্রাসী সংগঠন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ এনেছিল। আমরা চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলাম। কানাডার ফেডারেল কোর্ট তাঁরা রায় দিয়েছেন পদ্মা সেতুতে কোনো দুর্নীতি হয়নি। আবার সেই ফেডারেল কোর্টে আরেকটি রায় দিয়েছেন। সেটা হলো বিএনপি একটা সন্ত্রাসী সংগঠন। ’
বিএনপি কল্পনাই করতে পারেনি স্যাটেলাইট উেক্ষপণ হবে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আধুনিক প্রযুক্তির বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলেছি। স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ উেক্ষপণ করেছি। আমি বিএনপি নেতাদের জিজ্ঞেস করি, তারা কি কখনো কল্পনা করেছে, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট আকাশে উেক্ষপণ করবে? তারা তো কল্পনাই করতে পারেনি বোধ হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ সেটা করেছে। ’
যোগ দেয় শিশু, কিশোর ও বৃদ্ধরাও
মহাসমাবেশে যুবকদের পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের উপস্থিতিও উল্লেখযোগ্য ছিল। ছিলেন বৃদ্ধরাও। সকাল থেকেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলীয় নেতাকর্মীসহ নানা বয়সের সমর্থকরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জড়ো হতে থাকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে জনসমাগম। তারা বিভিন্ন ব্যানার, ফেস্টুুন, প্ল্যাকার্ড নিয়ে নানা স্লোগান দেয়। কয়েকজন শিশু-কিশোরের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাভার, গাজীপুর ও ময়মনসিংহ থেকে তারা সমাবেশে এসেছে।
চাঁদপুর জেলা যুবলীগের মিছিলে দেখা মিলে সত্তরোর্ধ্ব মো. নূর ইসলামের। নিজেকে আওয়ামী লীগের সমর্থক দাবি করে বলেন, ‘শেখের (বঙ্গবন্ধু) আমল থেকে আওয়ামী লীগ করি। ’ গফরগাঁও থেকে আসা কৃষক লীগের কর্মী ৭০ বছর বয়স্ক মাইনুদ্দিন বলেন, ‘খুব ভালো লাগছে। শেখ হাসিনার ভাষণ শুনব। ’
সকাল ১১টা থেকে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পল্টন ও প্রেস ক্লাব এলাকায় ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকার যুবলীগ নেতাকর্মীরা মিছিল করে সমাবেশস্থলে যাচ্ছেন। এ সময় পিকআপ ভ্যানে করে যুবলীগের নেতাকর্মীদের পল্টন-কাকরাইল এলাকায় অবস্থান করতেও দেখা যায়। প্রেস ক্লাবের সামনের তোপখানা রোডে গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকায় দুপুর ১টার পর পল্টন থেকে গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত যানজট সৃষ্টি হয়।
উত্সবমুখর পরিবেশে সমাবেশস্থলে নেতাকর্মীরা
মূলত দুপুর দেড়টার পর থেকে ঢাকার বাইরে থেকে আসা নেতাকর্মীদের মিছিলগুলো একে একে সমাবেশস্থলে আসতে থাকে। এ সময় আব্দুল গণি রোড ও হাইকোর্টের সামনের রাস্তা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, নরসিংদী, কেরানীগঞ্জ, রংপুর, ফেনী, কুমিল্লা, চাঁদপুর, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে আসতে থাকে সমাবেশে।
মিছিলগুলো হাইকোর্ট মোড়, দোয়েল চত্বর হয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে প্রবেশ করে। নেতাকর্মীদের সমাবেশ সফল করার স্লোগান দিতে দেখা যায়। উত্সবমুখর পরিবেশে আসা কোনো কোনো মিছিলে ছিল ব্যান্ড পার্টি। কর্মী-সমর্থকদের ভুভুজেলা বাজাতেও দেখা যায়। এলাকাভেদে বেশির ভাগ মিছিলেই নেতাকর্মীদের হলুদ, গোলাপি, সবুজসহ নির্দিষ্ট রঙের টি-শার্ট ও ক্যাপ পরতে দেখা যায়।
সড়ক বন্ধ, যানজট
মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে ছুটির দিনেও রাজধানীতে ছিল গণপরিবহনের সংকট। বিআরটিসি বাসসহ বিভিন্ন রুটের গণপরিবহন ভাড়া করে নেতাকর্মীরা সমাবেশে যোগ দেন। গণপরিবহনের সংকট থাকায় রাজধানীর বিভিন্ন বাসস্টেশনে যাত্রীদের অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায়। সমাবেশের কারণে শাহবাগ, মিন্টো রোড ও মত্স্য ভবনসহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রবেশ পথের বিভিন্ন প্রান্তে ডাইভারশন ছিল। এতে বিজয় সরণি, ফার্মগেট ও বাংলামটরে তীব্র যানজট দেখা যায়। যানজট এড়াতে ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে কাজ করেন অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা।
সমাবেশ শেষে ঢাকায় আসা সারা দেশের নেতাকর্মীরা একযোগে ফিরতে শুরু করেন। বিকেল সাড়ে ৫টায় রাস্তা থেকে ডাইভারশন সরিয়ে দেওয়া হলেও মত্স্য ভবন, কাকরাইল, তেজগাঁও শিল্প এলাকা হয়ে মহাখালী, কাকলী ও বনানী পর্যন্ত তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া শাহবাগ, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট ও বিজয় সরণিতেও ছিল যানজট।
বিশেষ নিরাপত্তাবলয়
মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে বিশেষ নিরাপত্তাবলয় গড়ে তোলা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সমাবেশ ঘিরে ২৯টি স্পট ও ৯টি প্রবেশপথে প্রায় পাঁচ হাজার পুলিশসহ র্যাব ও অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক ছিলেন। পুলিশের সঙ্গে প্রস্তুত ছিল জলকামান, প্রিজনভ্যান, বম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, সোয়াত, ডগ স্কোয়াডসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বিভিন্ন বিশেষায়িত ইউনিট।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম) এ কে এম হাফিজ আক্তার জানান, যেকোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় ডিএমপি প্রস্তুত ছিল।
যুবলীগ নেতার মৃত্যু
মহাসমাবেশে যোগ দিতে এসে রাজশাহীর যুবলীগ নেতা জিন্নাত আলী হারুনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল দুপুরে এ ঘটনা ঘটে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই মাসুদ বলেন, জিন্নাত আলী রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার বাকসিমইল ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি ছিলেন। সমাবেশে অসুস্থ হলে তাঁকে ঢামেকের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। চিকিত্সাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তাঁর। এ ছাড়া সমাবেশে অসুস্থ হয়ে মোহনপুর উপজেলার যুবলীগের সহসভাপতি খন্দকার মোতালেব হোসেন দোলনসহ আরো কয়েকজনকে ঢামেকে ভর্তি করা হয়।