যে তিনটি কারণে বিশ্বজুড়ে চলমান অর্থনৈতিক সংকট আগামী বছর আরও তীব্র হবে আশঙ্কা করছে সরকার। পরিস্থিতি সামাল দিতে খাদ্য উৎপাদন, মজুদ, রেমিট্যান্স ও বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধিসহ ছয়টি বিষয়ে জোরালো নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রিসভা। গতকাল সোমবার সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে বৈশ্বিক সংকট পর্যালোচনা শেষে নির্দেশনাগুলো দেওয়া হয়।
বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, বৈঠকে আলোচনা হয়েছে, সারা বিশ্বে যে সংকট দেখা যাচ্ছে, তাতে বাংলাদেশকে কতগুলো উদ্যোগ নিতে হবে। সম্প্রতি বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিবেদনগুলো বলছে- তিন কারণে ২০২৩ সাল খুবই সংকটের বছর হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। একটি হলো- যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের অব্যাহত সুদহার বৃদ্ধি। দ্বিতীয়টি হচ্ছে- কোভিডের পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার হওয়ার আগেই ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার ফলে যে অগ্রগতি শুরু হয়েছিল, সেটি নেতিবাচকতার চলে যাওয়া। তিন নম্বর কারণ হচ্ছে- উল্লেখযোগ্য পরিমাণে চীনের উৎপাদন কমে যাওয়া, যা আসলে বিশ্ববাজারকেই প্রভাবিত করছে।
এসব কারণেই আগামী বছর সংকটময় হওয়ার আশঙ্কার কথা তুলে ধরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘সবাইকে এই অনুযায়ী প্রস্তুত থাকতে হবে। এটি নিয়েই আজকে (গতকাল) রিপোর্ট উপস্থাপনের পর মন্ত্রিসভায় বিস্তারিত আলোচনা হয়।’
খন্দকার আনোয়ারুল বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্যরা বৈঠকে সংকট উত্তরণ নিয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। তাতে প্রথমেই দেশে সর্বাবস্থায় খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর কথা বলা হয়। খাদ্য আমাদানিতে যত বেশি মনোযোগ দেওয়া হবে, সংকট ততই বাড়তে থাকবে। যদিও ইউক্রেন ও রাশিয়াকে এখন মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে যে, খাদ্য রপ্তানিতে কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকবে না। তার পরও যুদ্ধটা সমস্যা সৃষ্টি করেই যাবে। আর বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে সমস্যা থেকে যাবে। কারণ যেহেতু ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার বৃদ্ধি হওয়ার কারণে যেসব দেশ ঋণগ্রহণ নিয়ে কাজ করে বা যাদের আমদানি বেশি, তাদের দুদিক থেকেই অসুবিধা হচ্ছে। এর একটি হলো- আমরা যখন টাকা দিচ্ছি, তখন আমরা বেশি দিচ্ছি। আবার যখন নিচ্ছি, তখন কম পাচ্ছি। সে জন্য ডাবল নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট হচ্ছে। এ জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ কাজ হলো- সবাইকে ফুড প্রোডাকশন বৃদ্ধি করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। এর সম্ভাবনাও আছে।
সংকট মোকাবিলায় বিদেশে দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর গুরুত্ব তুলে ধরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ শ্রমিক বিদেশে পাঠানো গেলে উচ্চ বেতন পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। সে ক্ষেত্রে যেসব দেশে আমরা পাঠাব, সেসব দেশের চাহিদা অনুসরণ করে তাদের যেন ক্যাপাসিটি বিল্ডিং (দক্ষতা বৃদ্ধি) করা হয়। সার্টিফিকেটগুলো যেন সঠিক প্রতিষ্ঠান থেকে তারা পায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। না হলে তাদের স্কিলের বা ট্রেনিংয়ের কোনো দাম থাকে না।’ রেমিট্যান্স বাড়াতেও বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে একটি সার্কুলার দিয়েছে যে, এখন থেকে রেমিট্যান্স পাঠাতে কাউকে ফি দিতে হবে না। এ ছাড়া রেমিট্যান্স প্রেরকদের বিশেষ সুবিধা দিতেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রক্রিয়া সহজ করা এবং তাদের কোনো তথ্য প্রয়োজন হলে ডাটাবেজ থেকে নেওয়ার বিষয়ে আলোচনার কথা জানান তিনি।
বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে বৈঠকের আলোচনা তুলে ধরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এ জন্য প্রয়োজনীয় শর্তগুলোকে সহজ করার বিষয় এসেছে। এ জন্য ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। শুধু বিডাতেই (বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) যাতে বিনিয়োগকারীরা সব সেবা পান, সে জন্য কাজ চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, এক বিডাতেই কয়েকটি উইন্ডো খোলা হবে। যেমন- পৌরসভা বা সিটি করপোরেশন থেকে কারখানার যে লাইসেন্স নিতে, তা সেখান থেকেই যেন নিতে পারে। করের বিষয়েও যেন এনবিআরে যেতে না হয়, সে ব্যবস্থাও থাকছে।
খন্দকার আনোয়ারুল বলেন, খাদ্য মজুদ ব্যবস্থাকে সবসময় সন্তোজজনক পর্যায়ে রাখতে হবে বলে মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। এটি এখন ‘অনেক সন্তোষজনক’ অবস্থায় আছে। বেসরকারি খাতকে অনেক খাদ্য আমদ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এর পরিমাণ প্রায় ১৫ লাখ টন।