প্রথমে কোটা সংস্কার ও পরে সরকার পতনের দাবিকে ঘিরে আন্দোলনের সময়ে সহিংস ঘটনা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত কার্যক্রম শুরু করছে জাতিসংঘ ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন। ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত এ ধরনের ঘটনা খতিয়ে দেখবে তারা। মানবাধিকার লঙ্ঘন, সহিংসতা ও মৃত্যুর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তৎকালিন আওয়ামী লীগ সরকার এবং পরে অন্তর্বর্তীকালিন সরকার– উভয়ই জাতিসংঘের সহায়তা চান। মোটা দাগে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে বাংলাদেশের দুটি সরকার জাতিসংঘের সহায়তা চায়, যদিও সহায়তা চাওয়ার ক্ষেত্রে দুই সরকারের প্রেক্ষিত ও দৃষ্টিভঙ্গী সম্পূর্ণ ভিন্ন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সাধারণত কোনও একটি দেশের অভিমত অনুযায়ী জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের কার্যক্রম পরিচালিত হয় না। তবে বাংলাদেশে ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের কার্যক্রমের পরিধি এবং ফলাফলের বিষয়ে এখনও অনেক অস্পষ্টতা আছে।
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের আন্তর্জাতিক তদন্ত একটি ভালো উদ্যোগ। তবে তদন্তের ইতিবাচক ফলাফলের জন্য বাংলাদেশ কীভাবে এগিয়ে যাবে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কী চায়– সেটির বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার।
এ বিষয়ে জেনেভায় বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি মো. সুফিউর রহমান বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার ও অন্তর্বর্তীকালিন সরকার– উভয়ই জাতিসংঘের সহায়তা চেয়েছে ভিন্ন উদ্দেশ্যে। এর অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশে ক্ষমতার পরিবর্তন হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে সহায়তার উদ্দেশ্যের পরিবর্তন হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন শক্তি রয়েছে। এর মধ্যে আছে বর্তমান উপদেষ্টমণ্ডলি, বিভিন্ন মতের রাজনীতিবিদ, শিক্ষার্থী, সামরিক ও বেসামরিক কর্তৃপক্ষ, সুশীল সমাজসহ সমাজের বিভিন্ন অংশ। একেক জনের চাওয়া একেক রকমের। ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের কাছে শক্তিগুলো কী চায় সেটি ভিন্ন। তাদের মধ্যে সহযোগিতার ধরন ও মাত্রাও ভিন্ন হবে। এর বিপরীতে মানবাধিকার হাইকমিশনারের অফিস ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেটি চায় সেটি সহজে অনুমেয়।’
ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন কী?
ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন হচ্ছে কোনও বিরোধ বা সংঘাত সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক তথ্য বিষয়ে অনুসন্ধান করা, কারণ নির্ণয় করা এবং তথ্য পর্যালোচনা করে বিশদ রিপোর্ট তৈরি করা। ১৯৬৩ সালে দক্ষিণ ভিয়েতনামের জন্য সর্বপ্রথম ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন গঠন করা হয়। এ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের জন্য শতাধিক ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন গঠন করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে একই দেশের জন্য একাধিক ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন গঠনের নজিরও আছে।
দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের জন্য মিশন গঠন করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। বাংলাদেশের জন্য এই প্রথমবারের মতো এই কমিশন গঠন করা হলো।
জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন গঠন করার নির্ধারিত পদ্ধতি আছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ, জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল, জাতিসংঘ মহাসচিব এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন গঠন করতে পারে।
বাংলাদেশের জন্য ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন গঠিত হয়েছে জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের অফিস থেকে।
বাংলাদেশের জন্য ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন
সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সংস্কার চেয়ে ১ জুলাই থেকে আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থীরা। পরে ১৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন স্থানে ছয়জন নিহত হওয়ার পর এটি সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। এরপর ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়।
১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সহিংস ঘটনায় ছয় শতাধিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্র দাবি করেছে। তবে ৫ আগস্টের পরও নাশকতা অব্যাহত ছিল। নিহতদের মধ্যে শিক্ষার্থী, শিশু, রাজনৈতিক কর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, মিডিয়াকর্মী, পেশাজীবী, সাধারণ মানুষসহ অন্যান্যরা রয়েছে। এর বাইরে আহত হয় সহস্রাধিক মানুষ।
আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে আটক বা গ্রেফতার, হয়রানি, ইন্টারনেট বন্ধসহ বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও আছে।
কোটা আন্দোলন
সহিংস ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য জুলাই মাসে শেখ হাসিনাকে লেখা এক চিঠিতে জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার ভলকার টুর্ক জানান, তদন্ত কাজে সহায়তার জন্য তার অফিস প্রস্তুত আছে। এরপর আন্দোলন চলাকালিন সময়ে ‘সহিংস ঘটনার’ তদন্তের জন্য জাতিসংঘের কাছে সহায়তা চায় তৎকালিন আওয়ামী লীগ সরকার। কোটা আন্দোলন নিয়ে সহিংসতা ও মৃত্যুর ঘটনার তদন্তের জন্য যে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করা হয়েছিল, ওই কমিশনকে টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স দেওযার জন্য জাতিসংঘের সহায়তার বিষয়টি নিয়ে আলোচিত হয়।
৮ আগস্ট দায়িত্ব গ্রহণের পর অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মোহাম্মাদ ইউনুস ভলকার টুর্কের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করেন এবং জাতিসংঘের নেতৃত্বে একটি ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন পাঠানোর অনুরোধ করেন।
মোটা দাগে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে বাংলাদেশের দুটি সরকার জাতিসংঘের সহায়তা চেয়েছে। যদিও সহায়তা চাওয়ার ক্ষেত্রে দুই সরকারের প্রেক্ষিত ও দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে বিশাল পরিবর্তন হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার ভলকার টুর্কের অফিস থেকে আগস্টের শেষে জানানো হয়েছে, জুলাইয়ের ১ তারিখ থেকে আগস্টের ১৫ তারিখ পর্যন্ত ৪৬ দিনে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার ‘নিরপেক্ষ ও স্বাধীন’ তদন্ত করবে জাতিসংঘ। একইসঙ্গে কারা এর সঙ্গে জড়িত, মানবাধিকার লঙ্ঘনের মূল কারণ কী, সেটিও খুঁজে বের করে ন্যায়বিচার ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা হবে। দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের বিষয়েও সুপারিশ করবে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন।
নিয়ামক ও ভূ-রাজনীতি
বৃহৎ ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের মাঝে কার্যক্রম পরিচালনা করে জাতিসংঘ। বৈশ্বিক সংস্থাটির কার্যক্রমকে বৃহৎ শক্তিগুলো বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে অথবা করার চেষ্টা করে। তবে বাংলাদেশে ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন পাঠানো বিছিন্ন কোনও ঘটনা নয়। ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের কর্মকাণ্ড, নির্ণায়ক সমূহ ও সুপারিশ ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রভাবিত হওয়া স্বাভাবিক।
এ বিষয়ে নর্থ সাউথ বিশ্বব্যিলয়ের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো সুফিউর রহমান বলেন, ‘এটি কোনও গোপন বিষয় নয় যে জাতিসংঘকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে থাকে বৃহৎ শক্তিগুলো।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে যে মাত্রায় মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে, সেজন্য মানবাধিকার কাউন্সিলে একটি বিশেষ অধিবেশন ডাকা হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকতো না। তবে এটি সম্ভবত হয়নি উপদেষ্টা পরিষদ ও প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের কারণে। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই ভলকার টুর্কের সঙ্গে আলোচনায় হাই কমিশনারের দফতর থেকে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন পাঠানোর বিষয়ে দ্রুত তারা একমত হয়েছেন।’
অন্যথায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের বিশেষ বা নির্ধারিত অধিবেশনে এজেন্ডাভুক্ত হয়ে বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে আলোচনা হওয়ার আশঙ্কা ছিল। একবার কোনও দেশ এজেন্ডাভুক্ত হলে সেটি থেকে বেরিয়ে আসা সময়সাপেক্ষ ও কষ্ঠসাধ্য হয়, এছাড়া নতুন ও নতুনতর ইস্যু সৃষ্টির ঝুঁকি তৈরি হয় বলে জানান সুফিউর রহমান।
দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অংশীদারদের সহায়তা ও অবস্থানের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন ও পরিমার্জনের মাত্রা বাংলাদেশের সাড়া দেওয়াকে প্রভাবিত করবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মিশনের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হলে তাতে যেসব নির্ণয় ও সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত হবে তার ব্যপ্তি ও গভীরতা নির্ভর করবে আগামী মানবাধিকার কাউন্সিলে বাংলাদেশ নিয়ে কী আলোচনা হতে পারে। এক্ষেত্রে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর অবস্থানও গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হবে।’
বাংলাদেশকে ঘিরে বৃহৎ শক্তিগুলোর একটি চাওয়া-পাওয়া আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশের পরিবর্তিত অবস্থান হয়তো ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের নির্ণয় এবং সুপারিশকে প্রভাবিত করতে পারে। এজন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের প্রধান কর্মকাণ্ড হিসাবে এবারের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অংশগ্রহণ এবং সেখানে বিভিন্নজনের সঙ্গে বৈঠক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’