যশোরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরে এবং ভবিষ্যতে বেশকিছু উন্নয়ন পরিকল্পনার কথা জানিয়ে আগামীতে নৌকায় ভোট চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।
বৃহস্পতিবার (২৪ নভেম্বর) যশোরের শামস্-উল হুদা স্টেডিয়ামে যশোর জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে এ কথা বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, নৌকায় ভোট দিয়ে আপনারা আমাদের নির্বাচিত করে সেবা করার সুযোগ দিয়েছেন। আগামী নির্বাচনে আমি আপনাদের ওয়াদা চাই, সেই নির্বাচনেও আপনারা নৌকায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে আপনারা দেশ সেবা করার সুযোগ দেবেন কিনা হাত তুলে ওয়াদা করেন।
এসময় উপস্থিত জনতা দু’হাত তুলে সমস্বরে নৌকার পক্ষে ভোট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি উপস্থিত নেতাকর্মী ও জনতাকে ধন্যবাদ জানান।
নির্বাচনে যশোরের সবকটি আসন থেকে নির্বাচিত করায় যশোরের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা।
এর আগে, সকাল থেকেই নেতাকর্মী আর সমর্থকদের মিছিলের স্রোত এসে জমতে শুরু করে যশোরের শামস্-উল হুদা স্টেডিয়ামে। দুপুর ১২টার আগেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় পুরো এলাকা। জনসমুদ্র স্টেডিয়াম ছাড়িয়ে বিস্তৃত হয় পাশের বিভিন্ন এলাকা ও সড়কে। যেন পুরো যশোর শহরেই জনসভা হচ্ছে। বৃহত্তর যশোরসহ আশপাশের জেলাগুলো থেকে লাখ লাখ মানুষের স্রোত এসে মেশে এখানে।
দুপুরে পবিত্র পবিত্র কোরআন তেলায়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। সভায় সূচনা বক্তব্য দেন যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহীদুল ইসলাম মিলন।
দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যশোর আসাকে কেন্দ্র করে পুরো সমাবেশস্থল উৎসবে রূপ নেয়। রং-বেরঙের পোশাক, ক্যাপ, গেঞ্জি পরে ব্যান্ডপার্টি তালে তালে মিছিল নিয়ে প্রবেশ করে স্টেডিয়ামে। জনসভাকে কেন্দ্র করে পুরো যশোর জেলা পরিণত হয় মিছিলের নগরীতে।
যশোরে বিএনপি সরকার কোনো উন্নয়ন না করলেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে যশোরের ব্যাপক উন্নয়ন করেছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, পঁচাত্তরের পর এদেশে আর কোনও উন্নয়ন হয়নি। কিন্তু আওয়ামী লীগ যখন থেকে ক্ষমতায় এসেছে তখন থেকে এ দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
এসময় যশোরে কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য একটি প্রকল্প শেষ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এবার আমরা দ্বিতীয় প্রকল্প হাতে নিয়েছি। এর ফলে যশোর-খুলনা-সাতক্ষীরার জলাবদ্ধতা দূর হবে। ৮২ কিলোমিটার নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে কাজ হাতে নিয়েছি। কপোতাক্ষের মতো ভবদহের জলাবদ্ধতা না থাকে সেই বিষয়েও আমরা পদক্ষেপ নেবো।
ভাঙা-যশোর-বেনাপোল, খুলনা-যশোর-কুষ্টিয়া, যশোর-খুলনা-মংলা-রাস্তাগুলো সব জাতীয় সড়কে উন্নীত করে দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, পদ্মা সেতু থেকে যেন যশোরে সরাসরি আসতে পারে। ভাঙা-যশোর রাস্তাও মহাসড়কে উন্নীত হবে।
তিনি বলেন, ২০১০ সালে যশোরে একটি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ৫’শ শয্যাবিশিষ্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল নির্মাণের প্রাথমিক কাজ এখন চলমান আছে। এটা আমরা নির্মাণ করে দিচ্ছি আপনাদের চিকিৎসাসেবা যাতে ভালো হয়। প্রত্যেকটি উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৩১ বেডের ছিল, আমরা তা ৫০ বেডে উন্নীত করে দিয়েছি।
এসময় যশোর স্টেডিয়ামকে উন্নত করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, প্রত্যেকটি উপজেলায় মিনি স্টেডিয়াম করে দিচ্ছি। খেলাধুলা ও সংস্কৃতি চর্চা করতে হবে। মাদক থেকে দূরে থাকতে হবে। এটা মানুষের জীবন ধ্বংস করে দেয়। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসে লিপ্ত হওয়া যাবে না। এদেশকে গড়ে তুলতে যুবকদের কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।
যশোরে উন্নয়নের কর্মকাণ্ড তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলেছি। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ইউনিয়ন পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এই যশোর থেকে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম। এখানে নির্মাণ হয়েছে সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, আইটি পার্ক, যেখানে দেড় থেকে দুই হাজার কর্মসংস্থান হয়েছে। যেখানে বিদেশ থেকে অনেক বিনিয়োগ আসছে।
‘যশোরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় করে দিয়েছিলাম। খালেদা জিয়া এসে অনেকগুলো বন্ধ করে দেয়। আমরা সেই বিশ্ববিদ্যালয় চালু করেছি। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা সবগুলোর উন্নয়নে কাজ করেছি। স্বাক্ষরতার হার যেখানে বিএনপির সময়ে ৪৫ ভাগ ছিল, সেটিকে আমরা ৭৫ ভাগে উন্নীত করেছি।’
পদ্মা সেতু ও মধুমতি সেতু হওয়ায় এই অঞ্চলের মানুষের সাথে ঢাকা যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তনের কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
এসময় তিনি যশোর বিমানবন্দরকে আরও আধুনিকায়ন করার জানিয়ে যশোর-চট্টগ্রাম নতুন রুট চালু করার কথা বলেন তিনি।
পদ্মা সেতু হওয়ার কারণে মোংলা সমুদ্রবন্দরের কার্যকারিতার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, এখন কিন্তু ঢাকা থেকে অনেক মাল চট্টগ্রামে যায় না, মোংলা বন্দরে যায়। এটা কিন্তু ক্ষমতায় এসে খালেদা জিয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। আমরা এসে সেটা আবার চালু করেছি।
অভয়নগরে ইপিজেড করার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে জমি নেওয়া হয়ে গেছে। ৫’শ একর জমি আমরা নিয়েছি। সেখানে ৪’শটা শিল্প প্লট হবে। বহু লোকের কর্মসংস্থান হবে। এখানে যে স্থলবন্দর, যেহেতু এখানে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে আমাদের যুব সমাজের কর্মসংস্থান হবে।
‘শুধু চাকরির পেছনে ছোটা নয়, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, নিজে কাজ করতে হবে। কর্মসংস্থান ব্যাংক করে দিয়েছি। সেখান থেকে বিনা জামানতে ৩ লাখ টাকা ঋণ পাওয়া যায়। এটা নিয়ে নিজেরাই ব্যবসা করতে পারবে।’
গুজব ছড়ানো বিএনপির কাজ মন্তব্য করে তাতে কান না দিতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘গুজবে কোনো কান দেবে না। বিএনপি কাজই হচ্ছে গুজব ছড়ানো। ওরা নিজেরা তো কিছু করতে পারে না। ক্ষমতায় এসে লুটপাট করে খেয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর জয় বাংলা স্লোগান নিষিদ্ধ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম নিষিদ্ধ, ইতিহাস বিকৃতি আর হত্যা ক্যু ষড়যন্ত্র। হাজার হাজার সেনা-বিমান বাহিনীর অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে। একের পর এক ক্যু হয়েছে আর সারারাত কারফিউ। এইতো ছিলো তখনকার অবস্থা। আর এই হত্যাকাণ্ডে জিয়া, মোশতাক এরা সবাই খুনি।’
দেশের মানুষের জন্য কাজ করার লক্ষ্য নিয়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন জানিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, ‘বিচার চাওয়ার অধিকার আমার ছিলো না। মা, বাবা, ভাই হারিয়েছি বিচার চাইতে পারবো না। তারপরও সবকিছু মাথায় নিয়ে ফিরে এসেছি বাংলার জনগণের কাছে। একটাই কারণ, এই জাতির জন্য আমার বাবা সারাজীবন সংগ্রাম করেছে। কাজেই আমার একটাই লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। সেই লক্ষ্য নিয়ে নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি।’
‘আপনাদের ভোটে নির্বাচিত হয়েই বার বার ক্ষমতায় এসেছি। আর ক্ষমতায় এসেছি বলেই এতো উন্নয়ন করা সম্ভব হয়েছে। যে বাংলাদেশকে ভিক্ষুকের জাতিতে পরিণত করেছিল, বিদেশ থেকে পুরনো কাপড় এনে এদেশের মানুষকে পরাতো; মানুষের পেটে খাবার ছিল না, মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না, রোগে চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে কমিউনিটি ক্লিনিক করে দিয়েছে। যেখান থেকে বিনা পয়সায় ৩০ ধরনের ওষুধ পাওয়া যায়।’
তিনি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ করে দিয়েছি। আর বিএনপি-জামায়াত সরকার ক্ষমতায় থাকতে কী দিয়েছে? দিয়েছে অস্ত্র, খুন, হত্যা। এই যশোরে শামসুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। মুকুলকে হত্যা করা হয়েছে। খুলনায় মঞ্জুরুল ইমাম, মানিক সমাহা, বাবু.. সাংবাদিকদের একে একে হত্যা করা হয়েছে। শুধু রক্ত আর হত্যা ছাড়া বিএনপি তো আর কিছুই দিতে পারেনি দেশের মানুষকে। আর নিজেরো লুটপাট করেছে। নিজেরা মানুষের অর্থ পাচার করেছে, মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। নিজেদের উন্নয়ন করেছে।
‘জিয়া যখন মারা যায় কোনও কিছু রেখে যায়নি। ভাঙা সুটকেস আর ছেঁড়া গেঞ্জি ছাড়া। কিন্তু সেই ভাঙা সুটকেস হয়ে গেলো জাদুর বাক্স। যেই বাক্স দিয়ে কোকো-আর তারেক হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে, দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে। আর পাচার করেছে বলেই তার শাস্তি হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে তারেক সাজাপ্রাপ্ত আসামি তারেক জিয়া। বাংলাদেশের অর্থ বিদেশে পাচার করার মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধে তার ৭ বছরের জেল আর ২০ কোটি টাকা জরিমানা। অস্ত্র চোরা কারবারি, এই অস্ত্র চোরাকারবারি করতে গিয়ে দশ ট্রাক অস্ত্র নিয়ে ধরা খেয়েছে। সেখানেও তার সাজা হয়েছে। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা করতে গিয়ে আমাকেসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী হত্যা করতে চেয়েছিল। সেই মামলায় সে সাজাপ্রাপ্ত। আর খালেদা জিয়া এতিমের টাকা মেরে দিয়ে সাজাপ্রাপ্ত। আর সাজাপ্রাপ্ত যে দলের নেতা সে জনগণকে কী দেবে? তারা কিছুই দিতে পারে না শুধু মানুষের রক্ত চুষে খেতে পারে। এটাই হলো বাস্তবতা।
যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য শাহীন চাকলাদারর।