অজানা আতঙ্ক কাটিয়ে সচল হওয়ার পথে মুগদা থানা

বাবাকে কন্যার প্রশ্ন, ‘কে বলছে পুলিশে চাকরি নিতে?’

ডেস্ক রিপোর্ট
  ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১১

প্রায় ২৫ বছর ধরে বাংলাদেশে পুলিশে চাকরি করছেন কনস্টেবল হুমায়ুন। দেশের ছয়টি বিভাগে কাজের অভিজ্ঞতা জমেছে তার ঝুলিতে। এক বছর হলো ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মুগদা থানায় কর্মরত। তিনি জানান, দীর্ঘ কর্মজীবনে গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলনের মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হননি আর কখনও। এই আন্দোলনে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে যেমন একদিকে প্রশ্ন উঠেছে, আবার অন্যদিকে পুলিশের ওপর নির্বিচারে হামলা ও মানুষের ক্ষোভ থেকে তৈরি হয়েছে আতঙ্ক বা অনিরাপত্তা বোধ। পেশাগত, সামাজিক, পারিবারিক সব দিক থেকে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা চাপে আছেন। পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে হুমায়ুন বলেন, ‘আমার ক্লাস নাইনে পড়ুয়া মেয়ে তার মাকে প্রশ্ন করেছে, বাবাকে কে বলেছে পুলিশে চাকরি করতে?’
নিজের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে এই পুলিশ সদস্য আরও বলেন, গত ৫ আগস্টের পর কর্মজীবনে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছি। পারিবারিক ও সামাজিক চাপ নিয়েই দায়িত্ব পালন করছি। এখন আবার আছে বদলি সংক্রান্ত চিন্তাও। দেশের প্রয়োজনে একেক সময় একেক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আমাদের ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশ পালন করতে হয়। অমান্য করার সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ছাত্র আন্দোলন কেন্দ্র করে পুলিশের ওপর যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে, এ নিয়ে সামাজিকভাবে যেমন হেয় হয়েছি, তেমনি পরিবারের লোকজনের কাছ থেকেও পেশা নিয়ে নেতিবাচক বার্তা পেয়েছি। আমার ক্লাস নাইনে পড়ুয়া মেয়ে তার মাকে প্রশ্ন করে, বাবাকে কে বলেছে পুলিশে চাকরি করতে, কেন পুলিশে চাকরি নিলো? আমার মেয়ের চোখে পুলিশের চাকরি ভালো না। হয়তো এ সম্পর্কে তাকে নেগেটিভ কিছু বুঝিয়েছে কেউ। অথবা তেমন কিছু দেখছে, আর এজন্যই একথা কথা বলছে, এমনটা ভাবছে। তখন তার মা তাকে উত্তর দিয়েছিল, তোমার বাবা যখন ছোট ছিল তখন এ চাকরি নিয়েছে।
থানার উপপুলিশ পরিদর্শক (এসআই) পূর্ণানন্দ বলেন, আমাদের সঙ্গে যেসব ঘটনা হয়েছে এখন আর এসব মনে করতে চাই না, মনে রাখতেও চাই না। অতীতের ঘটনা ভুলে যেতে চাই। এরকম ঘটনা আবার ঘটুক সেটাও আমরা চাই না। আমরা আগের মতোই জনগণের পাশে থেকে জনগণের সেবা করতে চাই। আর সে লক্ষ্যেই কাজ করছি। পুলিশ যেন জনগণের আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠে।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারা দেশে পাঁচ শতাধিক থানা হামলার শিকার হয়। এদিন বাদ যায়নি মুগদা থানাও। অন্যান্য থানার মতো মুগদা থানার ভেতরে অগ্নিসংযোগ করা হয়নি। তবে পুলিশের গাড়ি ও আসবাবপত্র লুটপাট, হামলা ও ভাঙচুর চালায় বিক্ষুব্ধ জনতা। তছনছ করা হয়েছে থানার অধিকাংশ কক্ষ। এসময় নিজদের প্রাণ বাঁচাতে সাধারণ পোশাকে পালাতে বাধ্য হন থানার সব পুলিশ সদস্য।
ওই দিন সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হওয়া এ হামলা, লুটপাট ও ভাঙচুর চলে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত। এ ঘটনার পর এখনও ভয়ে-আতঙ্কে আছেন থানার সবাই। তবে কর্মকর্তাদের দাবি, বর্তমানে ভয় ও অস্বস্তি কাটিয়ে জগণের পাশে দাঁড়াচ্ছে মুগদা থানা পুলিশের প্রতিটি সদস্য।
গত ১ অক্টোবর মুগদা থানায় গেলে দেখা যায়, চার তলা থানা ভবনের নিচে খোলা স্থানে এক দল পুলিশ সদস্য বসে ছিলেন। তাদের কপালে এখনও দুশ্চিন্তার ভাঁজ। তারা জানান, অনেকের বদলির অর্ডার হয়ে গেছে। পুরনো কর্মস্থল ছেড়ে নতুন জায়গায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন অনেকে।
সিঁড়ি বেয়ে এক তলা ওপরে উঠলে সামনেই থানার ডিউটি অফিসারের কক্ষ। সেখানে ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা যায় কর্মকর্তাদের। ওপরে লুটপাট হওয়া কক্ষগুলোতে নতুনভাবে সাজানো হয়েছে আসবাবপত্র।
থানার একাধিক পুলিশ সদস্য জানান, হামলার সময় কোনোরকম প্রতিরোধে না গিয়ে কৌশলে থানা থেকে বের হয়ে যান তারা। এজন্যই কোনও পুলিশ কর্মকর্তা বা সদস্য হতাহত হননি। যদিও তাদের ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশ ছিল, অ্যাকশনে গিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও এলাকার বাসিন্দা এক ব্যবসায়ী জানান, ওই দিন সন্ধ্যার পর হঠাৎ হাজার হাজার লোক থানার সামনে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে। ফুটপাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে থানায় হামলা ও লুটপাট চালায় তারা। আর সেই হামলা চলে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত। এসময় আতঙ্কে পুলিশ সদস্যরা এলাকা ছেড়ে চলে যায়। 
থানা সূত্রে জানা যায়, ৫ আগস্টের পর থানা কার্যক্রম ভেঙে পড়লেও এখন তারা আবার সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। গত সেপ্টেম্বর মাসে থানায় মামলা হয়েছে ১৭টি। এছাড়া প্রতিদিন নানা বিষয়ে শত শত সাধারণ ডায়েরি (জিডি) জমা পড়ছে।
এদিকে কর্মকর্তাদের রদবদল এখনও চলমান রয়েছে। সেজন্য থানার কোনও কোনও বিভাগে সদস্য কিছু কম-বেশি আছেন। থানায় তিন জন পরিদর্শক থাকার কথা, সেখানে এখন দায়িত্বে আছেন দুই জন। ৩৪ জন এসআই এর বদলে দায়িত্বে আছেন ২৫ জন। আবার ২৮ জন এএসআই মঞ্জুরি থাকলেও বর্তমানে কাজ করছেন ৩৪ জন। একইভাবে ৩৯ জন কনস্টেবলের মঞ্জুরি থাকলেও বর্তমানে কাজ করছেন ৫৪ জন। এছাড়া থানা এলাকায় টহল জোরদার করার জন্য চারটি গাড়ি সক্রিয় রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মুগদা থানার অফিসার্স ইনচার্জ ওসি মো. সাজেদুর রহমান বলেন, ৫ আগস্ট থানায় হামলা ও লুটপাট হয়েছে। তবে অন্যান্য থানার মতো মুগদা থানার তেমন বড় ধরনের ক্ষতি হয়নি, অগ্নিসংযোগ হয়নি। আমি যতদূর জেনেছি এই এলাকায় একটি গুলিও ছোড়া হয়নি। হামলায় যেসব ক্ষতি হয়েছে সেগুলো আমরা কাটিয়ে উঠেছি। কোনও হতাহত কিংবা অস্ত্র লুটের মতো ঘটনা এ থানায় ঘটেনি।
তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্টের পর আমাদের কার্যক্রম স্থবির ছিল। এখন জনগণ বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে থানায় আসছে, আমরা সেবা দিচ্ছি। মাঠে পুলিশের ভয়-আতঙ্ক কেটে উঠছে, তারা কাজে মনোযোগী হচ্ছে। জনগণ ও পুলিশ বাহিনীর মধ্যে যে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে সেটি দূর করতে আমরা যা যা করা দরকার সব ধরনের কাজ করছি। সাধারণ জনগণ টের পাচ্ছে পুলিশের অভাবটা, মাঠে যদি পুলিশ না থাকে তাহলে কী হয়। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরামর্শ এটাই- যেন দ্রুত আমরা জনগণের কাছে পৌঁছাতে পারি।
তিনি জানান, বিগত কিছু দিনের তুলনায় এখন আমাদের কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়ে আসছে। এলাকার লোকজনও স্বাচ্ছন্দ্যে থানায় বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে আসছেন। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি তাদের সেবা দেওয়ার। ৫ আগস্টের পর পুলিশ বাহিনীর অনুপস্থিতিতে মুগদা থানা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের কিছু চক্রের উৎপাত বেড়েছে, অপরাধ বেড়েছে। এসব নিয়ন্ত্রণ করতে আমরা বিশেষভাবে কাজ করছি।