চট্টগ্রাম অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি ১৫টি বধ্যভূমি রয়েছে পাহাড়তলী এলাকায়। বিষয়টি সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ৯ বছর পার হয়েছে। তারপরেও বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণে আদালতের দেওয়া নির্দেশ পালন করেনি সরকারের নির্বাহী প্রশাসন। উল্টো এসব স্থানে নির্মাণ হয়েছে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন। জেলা প্রশাসন বলেছে, বধ্যভূমির ভূমি অধিগ্রহণের জন্য মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে অর্থ বরাদ্দ চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কিন্তু টাকা পাওয়া যায়নি। আর মন্ত্রণালয় বলছে বধ্যভূমি সংরক্ষণে যে কোনো সময়েই বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব। আর এই টানাটানিতে ‘পাহাড়তলী জল্লাদখানা’ নামে পরিচিত বধ্যভূমি সংরক্ষণ প্রকল্প এখন হিমাগারে।
সাংবাদিক ও লেখক জামালউদ্দিন ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম শহর’ শীর্ষক বইয়ে জানিয়েছেন, ‘পাহাড়তলীর ওয়্যারলেস কলোনি এলাকায় পাক ২০ বালুচ রেজিমেন্টের ক্যাম্পে বিহারিদের সহযোগিতায় ফয়’স লেক বধ্যভূমিতে নিয়ে বাঙালিদের হত্যা করা হতো। বধ্যভূমির প্রথম জল্লাদ ছিলেন রেলওয়ের অবাঙালি কর্মী মকবুল খান।’ এ ছাড়া ‘প্রামাণ্য দলিল, মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ শীর্ষক বইয়ে পাহাড়তলীকে অন্যতম বড় বধ্যভূমি ও সেখানে ১৫টি বধ্যভূমি থাকার কথা উল্লেখ করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সমাজতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও মুক্তিযোদ্ধা ড. গাজী সালেহউদ্দিন। বধ্যভূমি সংরক্ষণে তিনি দীর্ঘদিন আন্দোলনও করেছেন। ওই বধ্যভূমিতে নিয়ে খুন করা হয় গাজী সালেহউদ্দিনের বাবা ও ভাইসহ একাধিক স্বজনকে।
নগরীর জাকির হোসেন সড়কের উত্তর পাশ লাগোয়া প্রায় দুই একর জায়গা মূলত পাহাড়তলী জল্লাদখানা নামে পরিচিত। মুক্তিযোদ্ধাদের আন্দোলন উপেক্ষা করে জায়গাটি কিনে নেন সাবেক জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম। তাকে সহায়তা করেন চট্টগ্রামের এক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা। বিএনপি সরকারের আমলে এই জমিতে ডা. নুরুল ইসলামের মালিকানাধীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (ইউএসটিসি) জন্য ‘শহীদ জিয়া বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন ভবন’ নির্মাণ করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ভবনের সাইনবোর্ড থেকে ‘শহীদ জিয়া’ শব্দ দুটি মুছে দেওয়া হয়। ভবনটির পশ্চিম পাশে অল্প জায়গায় একটি বধ্যভূমির স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে ইউএসটিসি কর্তৃপক্ষ। আর এভাবে পাহাড়তলী বধ্যভূমির পুরো জায়গা ইউএসটিসির দখলে চলে যায়।
১৯৯৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম ঢাকা রায়েরবাজার ও পাহাড়তলী বধ্যভূমি রক্ষার নির্দেশ দেন। ১৯৯৯ সালে সরকার জমি অধিগ্রহণের উদ্যোগ নেয়। বরাদ্দ দেওয়া হয় ৯৮ লাখ টাকা। ২০০৪ সালে চারদলীয় জোট সরকার প্রকল্পটি বাতিল করলে ওই অর্থ ফেরত যায়। সরকারের এই সিদ্ধান্তের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেন অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, মুনতাসীর মামুন ও অধ্যাপক গাজী সালেহউদ্দিনসহ কয়েকজন। সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের নির্দেশে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০১৪ সালের ১১ মার্চ দেওয়া এক আদেশে এক দশমিক ৭৫ একর জমির সম্পূর্ণ অংশ পাহাড়তলী বধ্যভূমি বলে রায় দেওয়া হয়। জমিটির বেশির ভাগ অংশ এখনো ইউএসটিসির দখলে রয়েছে।
পাহাড়তলী বধ্যভূমির জমিতে ২০০৬ সালে ইউএসটিসির নির্মিত ভবনের বিরুদ্ধে ২০১০ সালে আরেকটি রিট আবেদন করা হলে ওই ভবন নির্মাণে স্থগিতাদেশ দেন আদালত। ২০১১ সালের ৬ জুন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের আদেশে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির কাছে সাক্ষ্যদাতাদের বক্তব্য অনুসারে, ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই বধ্যভূমিতে বাঙালিদের ধরে এনে বিহারিদের সহায়তায় প্রায় ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল।
পাহাড়তলী বধ্যভূমি সংরক্ষণে আন্দোলনকারী অধ্যাপক ড. গাজী সালেহউদ্দিনের সহযোগী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও আবৃত্তিকার রাশেদ হাসান বলেন, চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় পাহাড়তলী বধ্যভূমি সংরক্ষণে আন্দোলন করতে গিয়ে প্রয়াত ড. গাজী সালেহউদ্দিন অনেকবার প্রাণনাশের হুমকিও পান। উচ্চ আদালতের রায়ের পরও বধ্যভূমিটি সংরক্ষণ দূরে থাক, কানো স্মৃতিচিহ্নও সেখানে দেয়নি প্রশাসন।
পাহাড়তলী বধ্যভূমি সংরক্ষণে অর্থ ছাড় প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (হিসাব) মো. জাহাঙ্গীর আলম আমাদের সময়কে বলেন, প্রায় ২ বছর আগে অর্থ বরাদ্দ চেয়ে একটি দরখাস্ত পাঠিয়েছিল চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। তখন চিঠির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় সময় বাড়িয়ে আরেকটি দরখাস্ত দেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই চিঠি আর আসেনি। তিনি বলেন, ‘পাহাড়তলী বধ্যভূমি ও মুক্তিযুদ্ধ কমপ্লেক্স করার জন্য অর্থ জমা আছে। যে কোনো সময় সেটা দেওয়া সম্ভব।’
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (ভূমি অধিগ্রহণ) মাসুদ কামাল বলেন, ‘এটা অনেক আগের কথা। আমাকে ফাইল দেখে বলতে হবে।’ চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনার এহসান মুরাদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘পাহাড়তলী বধ্যভূমি অধিগ্রহণ এবং সংরক্ষণের জন্য প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে কোনো অর্থ বরাদ্দ পাওয়ার তথ্য নেই।’