কুড়িগ্রামের শিশু মাইশার যখন মাত্র নয় মাস বয়স, তখন ডান হাতের তিনটি আঙুল চুলার আগুনে দগ্ধ হয়েছিল। চিকিৎসকরা বলেছিলেন, বয়স চার বছর হওয়ার পরে প্লাস্টিক সার্জারি করাতে হবে। তবে মা-বাবা আরও কিছুটা সময় নিয়ে সাড়ে পাঁচ বছরে মাইশার হাতে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেন। গত ৩০ নভেম্বর রাজধানীর মিরপুরের ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে মাইশার আঙুলে অস্ত্রোপচারও শুরু হয়। কিন্তু কে জানত, হাতের প্লাস্টিক সার্জারি করাতে এসে সন্তানের প্রাণটাই খোয়াতে হবে মাইশার বাবা-মাকে।
জানা গেছে, ওইদিন ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে মাইশার হাতে অস্ত্রোপচার করছিলেন জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটের সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. আহসান হাবীব এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সহকারী অধ্যাপক ডা. শারিফুল ইসলাম। এ সময় তারা শিশুটির বাবা-মাকে জানিয়েছিলেন, অস্ত্রোপচারের তিন ঘণ্টার মধ্যে মাইশার হাত ভালো হয়ে যাবে। সে অনুযায়ী অপারেশন থিয়েটারের বাইরে মেয়ের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তারা। কিন্তু ঘণ্টা পাঁচেক পরে অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয় মাইশার মৃতদেহ। পরে মা-বাবা বিস্ময়ে দেখেন, আঙুলের অস্ত্রোপচার করার কথা থাকলেও মাইশার পেটের নিচের অংশ পুরোটা কেটে সেলাই করা।
এ বিষয়ে জানতে শিশুটির বাবাকে (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) ফোন করলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। মাইশার খালাতো ভাই ইমন জানান, দীর্ঘদিন ধরে মাইশার চিকিৎসার জন্য
চেষ্টা করা হচ্ছিল। এমন সময় ক্যানসার হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. আহসান হাবীবের ঠিকানা পাই। তিনি মাইশাকে দেখে বলেন, প্লাস্টিক সার্জারি করলে ঠিক হয়ে যাবে। এ জন্য ৭০ হাজার টাকা লাগবে বলে জানান। শর্ত হলো, একদিনের মধ্যে টাকা জোগাড় করতে হবে। অন্যথায় তিনি বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখতে কাতার চলে যাবেন। ডা. আহসানের কথামতো মাইশার বাবা একদিনের মধ্যে ৭০ হাজার টাকা জোগাড় করেন। ৫০ হাজার টাকা অগ্রিম দিলে ৩০ নভেম্বর সকাল ৯টায় অস্ত্রোপচার শুরু করেন চিকিৎসকরা। দুপুর ১২টার দিকে অস্ত্রোপচার কক্ষ থেকে বেরিয়ে ডা. আহসান মাইশার বাবাকে জানান, অস্ত্রোপ্রচার প্রায় শেষ। এখন একটি বন্ডে সই দিতে হবে। কিন্তু অস্ত্রোপচার শেষে কেন বন্ডে সই করতে হবে জানতে চাইলে এর কোনো উত্তর মেলে না।
একপর্যায়ে দুপুর ৩টার দিকে ডাক্তার বেরিয়ে বলেন, মাইশার অবস্থা খারাপ। তাকে আইসিইউতে নিতে হবে। এ সময় চিকিৎসকরা নিজ দায়িত্বে অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করে মিরপুরের গ্লোবাল স্পেশালাইজড হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে যাওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক ইসিজি করে মাইশাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ সময় মাইশার মা কান্নায় ভেঙে পড়লে ডা. আহসান তাকে ধমক দিয়ে বলেন, কান্নাকাটি করলে লাশ পাবেন না। একপর্যায়ে তিনি নিজেই আবার অ্যাম্বুলেন্স ডেকে লাশ তুলে দেন। এমনকি অস্ত্রোপচারের আগে নেওয়া অগ্রিম ৫০ হাজার টাকাও ফেরত দেন।
এখানেই শেষ নয়, ডা. আহসানের ঠিক করা অ্যাম্বুলেন্স কুড়িগ্রাম যাওয়ার কথা। কিন্তু বগুড়া যাওয়ার পর চালক গাড়িতে সমস্যা আছে বলে মাইশার বাবাকে অন্য গাড়ি দেখতে বলেন। অন্য গাড়ি পেলে মাইশাকে নামিয়ে দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটি দ্রুত পালিয়ে যায়। বাড়িতে গিয়ে যখন মাইশার মরদেহ গোসল করাতে নেওয়া হয়, তখন বাবা-মা দেখতে পারেন মেয়ের পেটের নিচের দিকে এপাশ থেকে ওপাশ পুরোটাই কেটে সেলাই করা হয়েছে। এখন এ বিষয়ে কথা বলতে বা অভিযোগ দিতেও সাহস পাচ্ছে না মাইশার পরিবার।
গ্লোবাল স্পেশালাইজড হাসপিটালের মেডিক্যাল অফিসার ডা. তৌহিদুল আলম হাসিব স্বাক্ষরিত মাইশার মৃত্যুসনদে লেখা হয়েছে, বিপি ও পালস পাওয়া যাচ্ছে না। রোগীকে মৃত ঘোষণা করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে রেফার করেন তিনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত চিকিৎসক ডা. আহসান হাবীব দাবি করেন, অস্ত্রোপচার তিনি করেননি। শিশুটির হাত দগ্ধ ছিল। তাই এই অস্ত্রোপচার করেছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের সহকারী অধ্যাপক ডা. শরিফুল ইসলাম। অস্ত্রোপচারের আগে শিশু মাইশাকে পরীক্ষা করা হয়। এ সময় তার রক্তচাপ, পালস স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু অস্ত্রোপচারের একপর্যায়ে শিশুটির হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল মিরপুর শাখায় আইসিইউ না থাকায় শিশুটিকে দ্রুত মিরপুরের গ্লোবাল স্পেশালাইজড হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। পেটের সেলাই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্লাস্টিক সার্জারি করার জন্য শিশুটির পেটের চমড়া কাটা হয়েছে। এটি একটি দুর্ঘটনা, যা কারও কাম্য নয়।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় রাজধানীর কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সুরজিৎ দত্তের সঙ্গে। তিনি জানান, কারও প্লাস্টিক সার্জারি করার জন্য তার শরীরের যে কোনো অংশ থেকেই চামড়া নিতে পারেন চিকিৎসক। এটি নির্ভর করছে যেখানে নতুন চামড়া প্রতিস্থাপন করা হবে সেখানে চামড়ার পুরুত্বের ওপর।
এ বিষয়ে কথা হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীরের সঙ্গে। তিনি বলেন, একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে ঘটনার তদন্ত করা হবে। তদন্তে অভিযুক্ত চিকিৎসকের কোনো অপরাধ বা গাফিলতি প্রমাণ হলে তাকে পেতে হবে কঠিন শাস্তি।
একই মন্তব্য করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) অধ্যাপক ডা. শেখ দাউদ আদনান। তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। চিকিৎসক যদি অপরাধ করে থাকেন, তা হলে যিনিই হোক, তাকে শাস্তি পেতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ক্ষমা প্রদর্শনের সুযোগ নেই।
ডা. আহসান হাবীব রোগী দেখেন মিরপুর ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে। সেখান থেকে সার্জারির সব রোগী ভাগিয়ে নেন নিজের প্রতিষ্ঠান আলম মেমোরিয়াল হাসপাতালে। মাইশার বেলায় একই ঘটনা ঘটেছে। মাইশার বাবাকে তিনি বলেন, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে অস্ত্রোপচারে খরচ লাগবে ২ লাখ টাকা। অন্যদিকে তার হাসপাতালে করলে মাত্র ৭০ হাজার টাকা।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখা সূত্রে জানা গেছে, মিরপুরের রূপনগরের আলম মেমোরিয়াল হাসপাতালটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইসেন্সপ্রাপ্ত নয়। এটি একটি অবৈধ প্রতিষ্ঠান। তা ছাড়া ওই ডাক্তারের বিএমডিসি নিবন্ধন নম্বরটারও বৈধতা পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলাবিধি মোতাবেক চাকরিরত অবস্থায় কেউ কোনো ব্যবসা করতে পারবেন না।