নিউইয়র্কের ওজোনপার্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ উইন রোজারিও নিহত হওয়ার প্রতিবাদে বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। নিহতের পরিবার এবং বাংলাদেশি কমিউনিটি এ ঘটনায় দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
এদিকে ছয়দিন অতিবাহিত হলেও পুলিশের বডি ক্যামেরার ফুটেজ প্রকাশ না করায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশি কমিউনিটির অনেকেই। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ১৯ বছরের একজন মানসিক ভারসাম্যহীন তরুণের হাতে কাঁচি দেখে বিশ্বের চৌকস বাহিনী খ্যাত নিউইয়র্ক পুলিশের অফি- সাররা এতটাই ভয় পেয়ে গেলেন যে তার বুকে ছয় রাউন্ড গুলি চালাতে হলো। কাঁচিতে এত ভয় নিউইয়র্ক পুলিশের?
উল্লেখ্য, গত ২৭ মার্চ বুধবার দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটের দিকে নিউইয়র্কে বাংলাদেশি অধ্যুষিত কুইন্সের ওজোন পার্কের ১০৩তম স্ট্রিটে দ্বিতীয় তলার অ্যাপার্টমেন্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন উইন রোজারিও। গুলিতে নিহত হওয়ার আগে ওই তরুণ নিজেই পুলিশের সাহায্যের জন্য ৯১১ নম্বরে ফোন করেছিলেন। পুলিশ ওই বাসায় গিয়ে উইন রোজারিওর হাতে একটি কাঁচি দেখতে পায়।
পুলিশ জানিয়েছে, উইন রোজারিও কাঁচি হাতে নিয়ে পুলিশ অফিসারদের দিয়ে তেড়ে যান। একপর্যায়ে আত্মরক্ষার স্বার্থে পুলিশ কর্মকর্তারা তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই তার মুত্য হয়।
ওই ঘটনা নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে রোজারিওর ছোট ভাই উশতো রোজারিও পুলিশি ভাষ্যের ভিন্ন ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, গুলি ছোড়ার আগে পুরোটা সময় তার মা ভাইকে জাপটে ধরে রেখেছিলেন। এমনকি ভাইকে ধরা রাখা অবস্থায়ই গুলি ছোড়ে পুলিশ। এই গুলি ছোড়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। নিহত উইন রোজারিওর বাবা ফ্রান্সিস রোজারিও বলেন, ১০ বছর আগে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হন তাঁরা। যুক্তরাষ্ট্রের সাম- রিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন ছিল সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, মানসিক যন্ত্রণায় থাকা ওই তরুণের ব্যাপারে ৯১১ নম্বরে ফোনকল পেয়ে দুই পুলিশ সদস্য তার বাসায় যান। সেখানে পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ, বিশৃঙ্খলা ও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। পুলিশ সদস্যরা রোজারিওকে হেফাজতে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় তিনি একটি ড্রয়ার থেকে কাঁচি বের করে পুলিশের দিকে আসেন। তখন দুই পুলিশ
সদস্যই গুলি ছুড়ে তাঁকে বশে আনেন। এর আগে তার মা তাকে সহায়তা করতে এগিয়ে এসেছিলেন। ওই মুহূর্তে আত্মরক্ষার্থে পুলিশের গুলি ছোড়া ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না বলে দাবি করেন পুলিশ কর্মকর্তা চেল।
তবে রোজারিওকে কতটি গুলি করা হয়, সে বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি। পরিবার অবশ্য বলেছে, তাকে ছয়টি গুলি করা হয়। পুরো ঘটনার দৃশ্য পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে থাকা ক্যামেরায় ধারণ করা হয়েছে বলে জানান জন চেল। তবে তা তাৎক্ষণিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি।
উল্লেখ্য, গত দুই মাসে নিউইয়র্কে পুলিশের গুলিতে তিনজন নিহত হলেন। অন্যদিকে স্থানীয় সময় সোমবার নিউইয়র্কেও কুইন্সে ফার রকওয়েতে দুর্বৃত্তের গুলিতে জনাথন দিলার নামে একজন পুলিশ অফিসার নিহত হয়েছে। নিউইয়র্ক পুলিশে কর্মরত বাংলাদেশি আমেরিকান একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, যদি কেউ সামান্য একটি কাটা চামচ নিয়ে পুলিশের দিতে তেড়ে আসে, তাহলে পুলিশ আত্মত্মরক্ষায় গুলি চালিয়ে তাকে হত্যা করতে পারবে। এটিই নিউইয়র্ক সিটির আইন।
এদিকে পুলিশের গুলিতে নিহত বাংলাদেশি তরুণ উইন রোজারিওকে (১৯) হত্যার প্রতিবাদে নিউইয়র্কে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন প্রবাসীরা। গত ২৯ মার্চ স্থানীয় সময় শুক্রবার কুইন্সের জ্যাকসন হাইটসে ডাইভার- সিটি প্লাজায় অনুষ্ঠিত সমাবেশ থেকে দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের শাস্তির দাবি জানানো হয়। প্রবাসী বাঙালি খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশন ও লাল মরিচ নামে দুটি সংগঠন আলাদাভাবে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে। বিপুল প্রবাসী উইনের। পুলিশ ডিপার্টমেন্টের টহল প্রধান জন চেল এক বাংলাদেশি সমাবেশে যোগ দেন। সমাবেশে বক্তারা উইন রোজারিও হত্যার সঙ্গে জড়িত পুলিশ সদস্যদের অবিলম্বে শান্তির আওতায় আনার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে জোর দাবি জানান। তারা বলেন, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র দিন ইস্টার সানডে যেন এবার বিষাদে পরিণত হয়েছে। উইন রোজারিওর মৃত্যুর ঘটনার পর কমিউনিটি থেকে দাবি উঠলেও পুলিশের শরীরে থাকা ক্যামেরার কোনো ফুটেজ এখনও প্রকাশ করেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। সমাবেশে এ ব্যাপারেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন বক্তারা।
'প্রবাসী বাঙালি খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের সমাবেশে জড়ো হয়েছিলেন হিন্দু, বৌদ্ধ এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের সর্বস্তরের প্রতিনিধিত্বকারীরা। ছিলেন পেশাজীবী এবং ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতৃবৃন্দের সাথে গণমাধ্যম কর্মীরাও। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও প্রচণ্ড ক্ষোভ দেখায় এই সমাবেশ থেকে।
সমাবেশে ডেমোক্রেটিক পার্টির কুইন্স ডিস্ট্রিক্ট লিভার অ্যাট লার্জ অ্যাটর্নি মঈন চৌধুরী জানান, উইন রোজারিওর পরিবার এই হত্যাকাণ্ডে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনী লড়াই চালানোর জন্য তার সহযোগী ফার্মকে নিযুক্ত করেছেন। ইতিমধ্যেই তারা যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছেন। অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারদের বডি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহের পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়েছে। আনুসঙ্গিক সবকিছু তাদের ফার্মের বিশেষজ্ঞরা খতিয়ে দেখবেন।
ডেমোক্রেটিক পার্টির ডিস্ট্রিক্ট লিডার অ্যাট লার্জ অ্যাটর্নি মঈন চৌধুরী জানান, প্রচলিত রীতি অনুযায়ী উইন রোজারিওর হত্যাকাণ্ডের উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত শুরু করেছেন স্টেট অ্যাটর্নি জেনারেল। পাশাপাশি আমাদের ফার্মও তদন্তে নেমেছে। ন্যায় বিচারের জন্য আমরা সর্বোচ্চ পর্যায়ে লড়ে যাবো।
বিক্ষোভ সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন প্রবাসী বাঙাগি খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের
সাবেক সভাপতি গ্যাব্রিয়েল তাপস গমেজ, বিকাশ গমেজ, লুথারেন চার্চের প্যাস্টও জেমস রয়, দক্ষিণ এশিয়ান-আমেরিকানদের অধিকার
ও মর্যাদা নিয়ে কর্মরত 'স্যাফেস্ট'র প্রধান নির্বাহী মাজেদা এ উদ্দিন, কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট সৈয়দ আল-আমিন রাসেল, এএফএম মিসবাহুজ্জামান প্রমুখ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট সুখেন
গোমেজ। ১৯ বছর বয়সী বাংলাদেশি আমেরিকান উইন
রোজারিওর ছবিসহ প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস'। প্রত্যেকে ছিলেন সরব।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে নিহত বাংলাদেশি যুবক উইন রোজারিওর বাসায় গিয়ে পরিবারের সঙ্গে দেখা করেছেন নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল মো. নাজমুল হুদা। তিনি এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, এ ঘটনার তদন্ত হচ্ছে। তদন্তে পুলিশের দোষ প্রমাণিত হলে কর্তৃপক্ষ অবশ্যই উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবেন বলে আমরা আশা করি। নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে আগেই জানানো হয়েছে, অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারদের অস্ত্র কেড়ে নেয়া হয়েছে। তদন্তের ভিত্তিতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। গাজীপুর জেলার সন্তান উইন রোজারিও। প্রবাসের আঞ্চলিক সংগঠন গাজীপুর জেলা
অ্যাসোসিয়েশনের নারীবিষয়ক সম্পাদক রত্মা রোজারিওর ভাইয়ের ছেলে উইন রোজারিও। এ কারণে সংগঠনের পক্ষ থেকে এক বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে উইন রোজারিও হত্যার বিচার দাবি করা হয়েছে।
১ এপ্রিল সোমবার বিকালে ডাইভারনিটি প্লাজায় অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ সমাবেশে নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল মো. নাজমুল হুদা, মূলধারার রাজনীতিক গিয়াস আহমেদ, প্রবাসের আমব্রেলা সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটির সভাপতি মোহাম্মদ রব মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক মো. রুহুল আমিন সিদ্দিকী, অভিনয়শিল্পী খায়রুল ইসলাম সবুজ, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ডা. মাসুদুল হাসান, কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট শরীফ লস্কর, সৈয়দ আল-আমিন রাসেল প্রমুখ যোগ দিয়ে সংহতি প্রকাশ করেন।
বিক্ষোভ সমাবেশ পরিচালনা করেন গাজীপুর জেলা অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ইসহাক মোল্লা।