সিঙ্গাপুর যেভাবে পরিচ্ছন্ন ও উন্নত দেশে রূপান্তরিত হয়েছে

প্রবাস ডেস্ক
  ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২২:৩৫

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি পরিচ্ছন্ন দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত সিঙ্গাপুর। দেশটির কোথাও ময়লা-আবর্জনা তো দূরের কথা বালু-কণাও চোখে পড়বে না আপনার। একটি দেশ যে এত উন্নত ও পরিপাটি, তা সিঙ্গাপুর না গেলে তা বুঝতে পারবেন না। নির্দিষ্ট স্থানে ডাস্টবিন রাখা আছে, সেখানেই ময়লা ফেলা হয়।
জানা গেছে, ৫০ বছর আগেও সিঙ্গাপুর এত উন্নত ছিল না। অথচ এখন এটি বিশ্বের উন্নত দেশ গুলোর একটি। জানলে আরও অবাক হবেন, ছোট্ট এই সিঙ্গাপুরে চাষযোগ্য জমি নেই বললেই চলে। মাত্র ১০ শতাংশ দেশে উৎপাদিত হয় বাকিটা আমদানি করতে হয়। তারপরেও মাত্র ৫০ বছরে বিশ্বের অন্যতম সবুজ ও পরিষ্কার শহরে রূপান্তরিত হয়েছে সিঙ্গাপুর।
১৯৬০ সালের দিকে সিঙ্গাপুর ছিল কর্দমাক্ত নদী, দূষিত খাল ও বর্জ্য পানির অনিয়ন্ত্রিত প্রবাহসহ একটি উন্নয়নশীল দেশ। শহরের অনেক অংশে ছিল বস্তি। তখনকার সময় দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ব্যাপকভাবে সবুজায়নকে সমর্থন করে সিঙ্গাপুরকে একটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় উদ্যান নগরীতে পরিণত করার পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন।
তাছাড়া সিঙ্গাপুর একটি ছোট দ্বীপ হওয়ায় সেখানে প্রাকৃতিক সম্পদেরও অভাব ছিল। কেন্দ্রীয় সরকার সম্পদগুলোকে দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করার জন্য একটি পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি গ্রহণ করে। জানা গেছে, সিঙ্গাপুরের কেন্দ্রীভূত সরকার ব্যবস্থা তার বাসিন্দাদের শারীরিক-মানসিক সুস্থতা ও ভবিষ্যতকে অগ্রাধিকার দেয়।
দেশটি ১৯৭১ সালে ক্লিন এয়ার অ্যাক্ট চালু করে ও ১৯৭৩ সালে একটি পরিবেশ মন্ত্রণালয় স্থাপন করে। ১৯৭০ সালের মধ্যে ৫৫ হাজারের বেশি নতুন গাছ রোপণ করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালের মধ্যে বৃক্ষরোপণ দিবসও চালু হয় দেশটিতে।
১৯৭৫ সালে ‘পার্কস অ্যান্ড ট্রিস অ্যাক্ট’ সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে তাদের প্রকল্প ও ভবনগুলোতে সবুজায়নের জন্য জায়গা সংরক্ষিত করার অনুমতি দেয়। সিঙ্গাপুরের পরিবেশগত জ্ঞান বাড়ানোর জন্য ‘ক্লিন অ্যান্ড গ্রিন উইক’ ক্যাম্পেইনটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
বর্তমানে দেশটিতে গাছের সংখ্যা ১৯৭৪ সালে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৬০০ থেকে ২০১৪ সালে প্রায় ১.৪ মিলিয়নে উন্নীত হয়েছে। সিঙ্গাপুরে প্রায় ৯০ শতাংশ ম্যানগ্রোভ গাছ আছে। জানা গেছে, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশটিতে প্রায় ১ মিলিয়ন গাছ লাগানোর লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে। সরকার শহর-রাজ্যের বন্যপ্রাণীর জন্য বাসস্থান ও জীববৈচিত্র্য বাড়ানোর পরিকল্পনায় কাজ করে যাচ্ছে, যা মানুষের বসবাসের পরিবেশকেও উন্নত করে।
‘ওয়ান মিলিয়ন ট্রি’ প্রকল্পের মধ্যে অন্তর্দেশীয় ও ম্যানগ্রোভ উভয় বন পুনরুদ্ধার অন্তর্ভুক্ত আছে। ম্যানগ্রোভ অন্যান্য গাছের তুলনায় তিন থেকে পাঁচগুণ দ্রুত কার্বন সঞ্চয় করতে সাহায্য করে। প্রকল্পটি সিঙ্গাপুরকে বাতাস থেকে কার্বন নিঃসরণ কমাতে সাহায্য করবে। বিভিন্ন প্রচেষ্টার মাধ্যমে, সিঙ্গাপুর বিশ্বের অন্যতম পরিবেশগতভাবে প্রতিক্রিয়াশীল অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিঙ্গাপুরের জনসংখ্যা পাঁচ মিলিয়নেরও বেশি লোক ৭০০ বর্গ কিলোমিটারেরও কম এলাকায় বাস করে। এটি একটি ছোট দ্বীপ যেখানে শহর ও দেশ উভয়ের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে কম ভূমি সম্পদ আছে। উচ্চ জনসংখ্যার ঘনত্বের জন্য সবুজ স্থান তৈরি করা দেশের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ ছিল।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সঙ্গেও সবুজ স্থান তৈরি করার তাদের পরিকল্পনা হল গাছপালাগুলোর সঙ্গে স্থাপত্যকে একীভূত করে ও একটি উচ্চ-ঘনত্বের বিকাশ গ্রহণ করে। সবুজ স্থানগুলোর সঙ্গে বিল্ডিংগুলোর একীকরণের কারণে, দেশটি একটি প্রধান ইকো-পর্যটন গন্তব্যে পরিণত হয়েছে যা বৃহত্তম অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদান করে।
জানা গেছে, ‘এশিয়ার চার বাঘ’খ্যাত দেশগুলোর একটি হলো সিঙ্গাপুর। বাকি তিন দেশ হচ্ছে- হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান। সম্প্রতি বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক অর্থনীতির র্যাংকিংয়ে সিঙ্গাপুর শুধু হংকং, তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়াকেই নয়, যুক্তরাষ্ট্রকেও ছাড়িয়ে গেছে।
অর্থাৎ এশিয়ার ওভাররেটেড টাইগার এখন শুধু সিঙ্গাপুর। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এ দ্বীপ রাষ্ট্রটির অর্থনৈতিক অগ্রগতি বিস্ময়কর। অর্থ, শিক্ষা ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে দেশটি হয়ে উঠছে আধুনিক থেকে আধুনিকতর। পর্যটন ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে তাদের সাফল্য ঈর্ষণীয়।
সিঙ্গাপুর ভ্রমণে তাদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছে। সেখানকার রাতের জীবন, রেস্তোরাঁ, সাংস্কৃতিক আবহ সব মিলিয়ে একটি ঝকঝকে তকতকে যানজটমুক্ত আধুনিক শহর। সম্প্রতি বিশ্বের সেরা শহরগুলোর অন্যতম সেরা শহর হিসেবেও তালিকায় নাম উঠে এসেছে দ্বীপ দেশটির।
সর্বোচ্চ গুরুত্ব হিসেবে স্থান পেয়েছে, ‘করাপশন ফ্রি কানট্রি’। অত্যাধুনিক বিমান বন্দর, যা বর্তমান বিশ্বে সৌন্দর্যের দিক থেকে প্রথম স্থানে, সুবিন্যস্ত পর্যটন, বিনোদনসহ আর রয়েছে দারুণ সব শপিংমল। নাগরিক সেবাও অভূতপূর্ব। আইনশৃঙ্খলা এতটাই কঠোর যে, রাস্তাঘাটে ময়লা ফেলা তো দূরের কথা, চুইঙ্গাম খেলেও জরিমানা গুনতে হয়।
এসব উন্নয়নের পেছনে যার সবচেয়ে বড় অবদান তিনি হলেন আধুনিক সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাতা মি. লি. কুয়ান ইউ। বলতে গেলে যে দেশের তেমন কোনো সম্পদই ছিল না, সেখান থেকে টেনে তুলে এমন সিঙ্গাপুর তিনি নির্মাণ করেছেন, যা এখন বাকি বিশ্বের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ।
তিনি ২০১৫ সালে মৃত্যুবরণ করলে সুযোগ্য সন্তান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মি. সিয়েন লং তার মেধা ও শ্রমের মাধ্যমে দ্বীপরাষ্ট্রটিকে উন্নয়নের শীর্ষস্থানে পৌঁছে দেন। সিঙ্গাপুরে প্রধানত একটিই পলিটিকাল পার্টি আছে, যা ‘পিপলস অ্যাকশন পার্টি’ নামে পরিচিত। পার্লামেন্টে মোট ৮৪টি আসনের মধ্যে ৮৩টি সিট পিপলস অ্যাকশন পার্টির করায়ত্ত। কাজেই সিঙ্গাপুরকে ওয়ান পার্টি স্টেট হিসেবেও অভিহিত করা হয়।
সেক্ষেত্রে দেশটিতে প্রকৃত গণতন্ত্র আছে কি না যুক্তরাষ্ট্রতেও তা নিয়ে বাকবিতণ্ডা আছে। তবে এ নিয়ে ওদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো মাথাব্যথা নেই। দেশে কোনো অভাব অনটন নেই বিধায় সরকারের সব কর্মকাণ্ডকেই তারা ভালো চোখে দেখে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের সুদক্ষ পরিচালনায় অতি অল্প সময়ে দেশটির সব মানুষ রূপান্তরিত হয়েছে সম্পদ ও পুঁজিতে।
সিঙ্গাপুরে বসবাস করা বাংলাদেশের রাজবাড়ি জেলার রৌকনুজ্জামান মীর্জা বলেন, ‘আমি প্রায় ১০ বছর ধরে সিঙ্গাপুর আছি। এখানে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করে এখন চাকরি করছি। দেশটি খুবই পরিচ্ছন্ন। কোথাও সামান্য ময়লাও চোখে পড়বে না। এই দেশের নাগরিকরা এসব বিষয়ে খুবই সচেতন। আমাদের মত প্রবাসীরাও এসব বিষয়ে খুব সচেতন থাকেন।’