‘আপেল মাহমুদ একজন মুক্তিযোদ্ধা, এটাও প্রমাণ দিতে হল’

কুমিল্লা সংবাদদাতা
  ০৩ জুন ২০২৫, ১৩:১২

মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত যেসব গান রণাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধাসহ সারা দেশের মানুষকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম- ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি'।
কালজয়ী এই গানের গীতিকার ও সুরকার আপেল মাহমুদ। নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা প্রমাণ করতে সোমবার তাকে হাজির হতে হয়েছিল জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের শুনানিতে।
সেখানে শুনানি শেষে একুশে পদকপ্রাপ্ত এই গীতিকার বলেন, “আমি আপেল মাহমুদ যে একজন মুক্তিযোদ্ধা, তা জীবিত থেকেই দ্বিতীয়বার প্রমাণ করেছি। আমি মুক্তিযোদ্ধা নই সেই অভিযোগটি ভুল প্রমাণিত হওয়ায় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল- জামুকার সদস্যরা দুঃখ প্রকাশ করেছেন।”
আপেল মাহমুদ মুক্তিযোদ্ধা নন বলে অভিযোগটি করেছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কর্মী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মনোয়ার হোসেন।
গত বছরের ৫ অগাস্টের পর করা এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ১২ মে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের উপ-পরিচালক (উন্নয়ন) ফাতেমা খাতুন আপেল মাহমুদ এর স্বপক্ষে যাবতীয় দলিল ও স্বাক্ষ্য উপস্থাপনের জন্য নোটিশ জারি করেন। সেজন্য ২ জুন কুমিল্লা সার্কিট হাউজে শুনানির জন্য আপেল মাহমুদকে ডাকা হয়।
শুনানি শেষে আপেল মাহমুদ আরও বলেন, “তিন নম্বর সেক্টরে আমি সরাসরি যোদ্ধা। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের কমান্ডে যুদ্ধ করেছি। একাত্তরের ১০ই এপ্রিল পর্যন্ত আমরা নরসিংদীর পাঁচদোনাসহ বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করেছি।
“নরসিংদী ফল করে ১০ তারিখে। আমরা চলে যাই ক্যাপ্টেন নাসিমের আন্ডারে আশুগঞ্জে। সেখানে আমরা ভৈরব রামনগর ব্রিজে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করি। সেখান থেকে রামনগর ব্রিজ, ভৈরব, আশুগঞ্জ, হবিগঞ্জ, চুনারুঘাট, চানপুর টি স্টেট, তেলিয়াপাড়া টি স্টেটে যুদ্ধ করেছে। তেলিয়াপাড়া ১৯৭১ সালে আমার শেষ যুদ্ধ ক্ষেত্র ছিল।”
আপেল মাহমুদ বলেন, “আশুগঞ্জের যুদ্ধের সময় আমার বামপাশের চোখের পাশে আঘাতপ্রাপ্তও হই। পরে আমাকে আগরতলা নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার ভাইও আসেন। ২৫শে মে কলকাতায় বড় করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হল।
“শুরুতেই আমাকে এবং জব্বার ভাইকে শরণার্থীদের জন্য একটি অনুষ্ঠান করতে হয়েছে। আমরা তখন দুইদিন অনুষ্ঠান করে অনেকগুলো শিল্পী পাই।”
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই শব্দসৈনিক বলেন, “পহেলা জুন থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আমার উপর যে দায়িত্ব ছিল তা ২০০৬ এ রিটায়ারমেন্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ বেতার বা রেডিও বাংলাদেশ যাই বলেন না কেন সেই দায়িত্ব পালন করেছি।”
তিনি আরও বলেন, “আমি তো মনোয়ার হোসেনের কোনো ক্ষতি করিনি- জানি না তিনি কেন এমন করলেন।”
এসময় তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন সহধর্মিনী নাসরিন মাহমুদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা একুশে পদকপ্রাপ্ত শব্দসৈনিক মনোরঞ্জন ঘোষাল, বাংলাদেশ বেতারের সাবেক পরিচালক বীর মুক্তিযোদ্ধা আশরাফুল আলম, বীর মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর হায়াত খান, বীর মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ সাহাসহ অন্যরা।
শুনানি শেষে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের মহাপরিচালক শাহিনা খাতুন বলেন, ৫ অগাস্টের পরে কুমিল্লা জেলা থেকে ৩১জন মুক্তিযোদ্ধা নন এমন অভিযোগ ওঠে। সেই সব অভিযোগের প্রেক্ষিতে কুমিল্লা সার্কিট হাউসে দুইটি কমিটিতে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আপেল মাহমুদ প্রমাণ করেছেন তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা।
তিনি আরও বলেন, “আপেল মাহমুদ যদি শুধু গান গেয়ে উদ্বুদ্ধ করার মতো ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকতেন তাহলে তিনি সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে খেতাব পেতেন। কিন্তু তিনি কাগজেপত্রে প্রমাণ করেছেন তিনি সম্মুখযোদ্ধাও ছিলেন। তাই তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা বিষয়টি নিশ্চিত।”
কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার বাসিন্দা আপেল মাহমুদের গাওয়া ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’ এই গানটি পরে ২০০৬ সালে এটি বিবিসি কর্তৃক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গান হিসেবে শ্রোতা মনোনীত ২০ সেরা গানের মধ্যে সপ্তম অবস্থানেও অর্ন্তভূক্ত হয়েছিল।
এ ছাড়াও “তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর” তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য গান। দেশাত্মবোধক গান ছাড়াও তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত, লালনগীতি, গণসঙ্গীত ও আধুনিক ধারার গান গেয়েছেন। সঙ্গীতে অবদানের জন্য তিনি ২০০৫ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদকে ভূষিত হন।