ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)।
বৃহস্পতিবার এই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এটিই পশ্চিমা গণতন্ত্রের আদলে তৈরি কোনো দেশের নেতার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির প্রথম ঘটনা।
আইসিসি বলছে, ক্ষুধাকে ব্যবহার করে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের জন্য এই দুইজনকে দায়ী করার যৌক্তিক ভিত্তি রয়েছে।
তবে আন্তর্জাতিক আদালতের এই পদক্ষেপকে ইহুদিবিদ্বেষী বলে মন্তব্য করেছেন নেতানিয়াহু।
একইসঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগকে ‘অযৌক্তিক’ ও ‘মিথ্যা’ উল্লেখ করে তা প্রত্যাখ্যানও করেন তিনি।
দাবি করেন, গত বছর ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে চালানো হামলার জবাবেই হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দেশটি।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছাড়াও হামাসের সামরিক কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফের বিরুদ্ধেও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে আদালত।
যদিও গত জুলাইয়ে তাদের এক বিমান হামলায় দেইফের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেছিল ইসরায়েল। তবে হামাস আজও এই তথ্য নিশ্চিত করেনি।
দেইফের মৃত্যু নিয়ে দোলাচল থাকায় স্বাভাবিকভাবেই গ্রেফতারি পরোয়ানাটি কেবল ইসরায়েলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য বলে জানান বিবিসির নিরাপত্তাবিষয়ক সংবাদদাতা ফ্রাঙ্ক গার্ডনার।
শুক্রবার বিবিসির গ্লোবাল নিউজ পডকাস্টে যুক্ত হয়ে গার্ডনার বলেন, আর আংশিকভাবে সে কারণেই ইসরায়েলি জনতা ও নেতারা এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। অন্যদিকে গাজায় কেবল হামাস ও ইসলামিক জিহাদী গোষ্ঠীই না, সাধারণ ফিলিস্তিনিরাও এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে।
গাজাবাসী এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেছে, অবশেষে পৃথিবী তাদের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।
তবে চলমান এসব ঘটনার মধ্যেই গাজায় চালানো ইসরায়লি বিমান হামলায় গত ৩৬ ঘণ্টায় আরও ৭০ জনের মৃত্যুর কথা জানান গার্ডনার।
একইসঙ্গে গাজার উত্তরাঞ্চলে খাবার আর ওষুধের অভাবে মানবেতর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলেও জানান তিনি।
নেতানিয়াহু, গ্যালান্ট ও দেইফের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০২ সালে।
নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত এই আন্তর্জাতিক আদালতের উদ্দেশ্য ছিল, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের মতো নৃশংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনা।
তবে এটি জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) থেকে আলাদা।
আইসিসির নিজস্ব কোনো পুলিশ বাহিনী নেই। ফলে জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানা কার্যকর করার জন্য তারা তাদের সদস্যভুক্ত দেশগুলোর ওপর নির্ভর করে।
এই আদালত প্রতিষ্ঠার জন্য মোট ১২৪টি দেশ ‘রোম স্ট্যাটিউট’ নামে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।
এর মধ্যে ৩৩টি আফ্রিকান, ১৯টি এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয়, ১৯টি পূর্ব-ইউরোপীয়, ২৮টি ল্যাটিন অ্যামেরিকান এবং ক্যারিবীয় ও ২৫টি পশ্চিম ইউরোপীয় ও অন্যান্য রাষ্ট্র রয়েছে।
তবে এটিকে আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন ও ইসরায়েল।
ইসরায়েল আইসিসির সদস্য দেশ না হওয়ায় এর ওপর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কোনো এখতিয়ার নেই বলে দাবি করে দেশটি।
তবে বৃহস্পতিবার গ্রেফতারি পরোয়ানা ঘোষণা করার সময় আইসিসি জানায় যে এর সদস্য রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের আঞ্চলিক বিচারিক এখতিয়ারের ভিত্তিতে ইসরায়েলের ওপর বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে।
যদিও কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আইসিসি সাধারণত অনুপস্থিত আসামিদের বিচার করে না।
যার অর্থ দাঁড়ায়, সম্ভবত নেতানিয়াহু ও গ্যালান্ট আইসিসির কোনো সদস্য রাষ্ট্রে ভ্রমণ করা বা গ্রেফতার না হওয়া কিংবা দুজনকে হেগে না আনা পর্যন্ত তাদের বিচারের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
ফলে পরোয়ানা জারি হলেও নেতানিয়াহু কিংবা গ্যালান্টকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেফতারের মুখোমুখি হতে হবে না।
তবে এরপর থেকে তাদের জন্য যেকোনো দেশে ভ্রমণ করা জটিল হবে, একইসঙ্গে এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইসরায়েলকে আরও বিচ্ছিন্ন করার হুমকি তৈরি হলো।
স্বাভাবিকভাবে নেতানিয়াহু আর গ্যালান্ট যদি আইসিসি সদস্যভুক্ত কোনো দেশে পা রাখেন তাহলে তাদেরকে গ্রেফতার করে আদালতের কাছে তুলে দেওয়ার কথা।
নেতানিয়াহু সবশেষ জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান, যা কি না আইসিসির সদস্যভুক্ত না।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আইসিসির গ্রেফতারি পরোয়ানাকে ‘আপত্তিজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
এদিকে খোলাখুলিভাবেই নিজেদের ভূখণ্ডে যেকোনো অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতারের কথা জানিয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দুই দেশ ইতালি ও নেদারল্যান্ডস।
নির্দিষ্টভাবে কোনো কিছু উল্লেখ না করলেও আইসিসি-র নিয়ম মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশ।
ইইউ’র পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল বলেছেন, ইইউ'র সব সদস্য রাষ্ট্রের জন্য আইসিসির সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার ‘বাধ্যবাধকতা’ রয়েছে।