ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা পাওয়ার প্ল্যান্টে উৎপাদিত কিছু বিদ্যুৎ নিজ দেশে বিক্রি করতে সরকারের কাছে বিশেষ ছাড় চেয়েছে ভারতীয় শিল্প গোষ্ঠী আদানি।বাংলাদেশ ঠিকমতো বকেয়া পরিশোধ না করায় ভারতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকারের কাছে বিশেষ ছাড় চাওয়া হয়েছে।
একাধিক সূত্রের বরাত দিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু বিজনেস লাইন এ তথ্য জানিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আদানি পাওয়ার লিমিটেড ভারতের পূর্বাঞ্চল ঝাড়খণ্ডে অবস্থিত তাদের ২ বিলিয়ন ডলারে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সরকারের কাছে নতুন সুবিধা দাবি করছে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের একমাত্র ক্রেতা বাংলাদেশ। তবে কোম্পানিটির দাবি, বাংলাদেশ ঠিকমতো বকেয়া পরিশোধ না করায় তারা ঝামেলায় পড়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্রগুলো জানিয়েছে, আদানি পাওয়ার এই কেন্দ্র চালানোর জন্য ব্যবহৃত আমদানি করা কয়লার শুল্কমুক্তির সুবিধা অব্যাহত রাখার দাবি জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে। এই সুবিধা ছাড়া ভারতের বাজারে বিদ্যুতের যে দাম তার চেয়ে বেশি হয়ে যাবে আদানির বিদ্যুতের দাম। ফলে গ্রাহকদের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে।
এই বিষয়ে ই-মেইলের মাধ্যমে মন্তব্য চাওয়া হলেও আদানি পাওয়ার কোনো মন্তব্য করেনি।
আদানির গোড্ডা পাওয়ার প্ল্যান্ট বাংলাদেশের মোট বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রায় এক দশমাংশ সরবরাহ করত। সেপ্টেম্বর নাগাদ বাংলাদেশের কাছে কোম্পানিটির বকেয়া দাঁড়ায় ৭৯০ মিলিয়ন ডলার। তবে এরই মধ্যে বাংলাদেশ বেশ কিছু বকেয়া পরিশোধ করেছে এবং পরিশোধ অব্যাহত রাখবে বলেও জানিয়েছে।
গত আগস্টে ভারতের বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় আদানিকে এই কেন্দ্র থেকে ভারতের অভ্যন্তরেও বিদ্যুৎ বিক্রির অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রটি একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় অভ্যন্তরীণ বিক্রিতে বাধা সৃষ্টি করছে সংশ্লিষ্ট আইন। আর তাই ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যদি বিশেষ ছাড় না দেয়, তাহলে উৎপাদিত বিদ্যুৎ আমদানি পণ্য হিসেবে গণ্য হবে এবং এ জন্য আদানির বিদ্যুতের ওপর কর আরোপ করা হবে।
আদানি পাওয়ার (ঝাড়খন্ড) লিমিটেড ও বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (বিপিডিবি) মধ্যে এই ‘পাওয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্ট’টি স্বাক্ষরিত হয় ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর, যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি সফর করছিলেন।
আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কত পরিমাণ বিদ্যুৎ কত দিন ধরে বাংলাদেশে সরবরাহ করা হবে, তার দাম কী হবে এবং কোন কোন শর্তের অধীনে – এগুলোর সব কিছুই ওই চুক্তিতে নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। যদিও চুক্তিটি তখন জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি।
এর অনেক পরে ২০২৩ সালের গোড়ার দিকে অস্ট্রেলিয়া-ভিত্তিক ওয়াচডগ ‘আদানি ওয়াচ’ ১৬৩ পৃষ্ঠার ওই চুক্তিপত্রটি নিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ততদিনে অবশ্য সেই চুক্তির বিভিন্ন ধারা নিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে।
ওয়াশিংটন পোস্টের একটি প্রতিবেদনে একজন আন্তর্জাতিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছিল, এই চুক্তিটিই এমন যে বাংলাদেশে বাল্ক ইলেকট্রিসিটির যে বাজারদর, তারা সেটার অন্তত পাঁচগুণ বেশি দামে আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনতে বাধ্য হবে।
২০২২-এ প্রকাশিত একটি বেসরকারি গবেষণা রিপোর্ট বলেছিল, এই প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ কেনার জন্য বাংলাদেশ আগামী ২৫ বছরে আদানিকে ১১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ দিচ্ছে – যে পরিমাণ অর্থ দিয়ে সে দেশে তিনটে পদ্মা সেতু বা ন’টা কর্ণফুলী টানেল তৈরি করা সম্ভব। এই ‘পিপিএ’-তে যে পাঁচিশ বছরের ‘লক ইন পিরিওড’ রাখা হয়েছিল, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
কারণ চুক্তিপত্রে বাংলাদেশ সরকার আদানিকে ‘রাষ্ট্রীয় ও সার্বভৌম গ্যারান্টি’ দিয়েছিল যে পরবর্তী ২৫ বছর ধরে তারা গোড্ডায় উৎপাদিত বিদ্যুতের পুরোটাই কিনে নেবে।