যুদ্ধের সময় আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ, সংঘাত-হানাহানি, হত্যা-ধ্বংসযজ্ঞ ও রক্তপাতের মতো অস্বাভাবিক ঘটনাও স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। এর প্রভাবে ব্যক্তি ও সমষ্টিগত জীবনে ঘৃণা, আক্রোশ, হিংসা, জিঘাংসার মতো তীব্র নেতিবাচক মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা প্রবলভাবে সক্রিয় হয়। যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হয়, তীব্র মানসিক ধকল বা ট্রমাও তত প্রকট রূপ নেয়। ধকল কাটানো হয়ে পড়ে বেশ কঠিন। এমনই কয়েকটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছে আলাদাভাবে। আসুন, মানব ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে চলা যুদ্ধগুলো সম্পর্কে একনজরে জেনে নিই—
রিকনকুয়েস্টা : ইউরোপের স্পেন আর পর্তুগালের যোদ্ধাদের সঙ্গে তৎকালীন আইবেরীয় উপদ্বীপের মুসলিম যোদ্ধাদের মধ্যে এ যুদ্ধ হয়েছিল। ইতিহাসে এটা ‘রিকনকুয়েস্টা’ নামে পরিচিত। মুসলিম যোদ্ধারা জিব্রাল্টার প্রণালী অতিক্রম করলে ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে যুদ্ধের সূচনা হয়। পরে তাঁরা ৭১৮ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে পুরো স্পেন ও পর্তুগাল দখলে নেন। পতন হয় ইউরোপীয় খ্রিষ্টান সাম্রাজ্যের। পরবর্তী সময়ে ১১ শতকের দিকে খ্রিষ্টানরা আবার শক্তিশালী হতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় ফার্দিনান্দ আর প্রথম ইসাবেলার যোদ্ধাদের হাতে গ্রানাডার পতনের মধ্য দিয়ে কয়েক শতকের এ যুদ্ধের সমাপ্তি হয়। রিকনকুয়েস্টা টানা ৭৮১ বছর ১ মাসব্যাপী চলেছিল। ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধ।
রোমান-জার্মান যুদ্ধ : প্রাচীন ইউরোপের ভূখণ্ডে দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব বিস্তার করা যুদ্ধগুলোর একটি রোমান-জার্মান যুদ্ধ। দুই প্রভাবশালী সভ্যতার মধ্যকার এ যুদ্ধ শুরু হয় ১১৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে, শেষ হয় ৫৯৬ খ্রিষ্টাব্দে। পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের মধ্য দিয়ে চূড়ান্তভাবে শেষ হওয়া এ যুদ্ধ চলেছিল প্রায় ৭০৮ বছর। ইতিহাসে দীর্ঘ সময় ধরে চলা দ্বিতীয় যুদ্ধ এটা। সাত শতকের বেশি সময় ধরে দুই সভ্যতার মধ্যে চলা এ সংঘর্ষের ফলে খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে দশম খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রোমান সাম্রাজ্য ও জার্মানিক পূর্বপুরুষশাসিত অঞ্চলগুলোতে বড় ধরনের বাস্তুচ্যুতির ঘটনা ঘটে।
অ্যাংলো-ফরাসি যুদ্ধ : ফরাসি ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার এ যুদ্ধের সুদূরপ্রসারী প্রভাব ইউরোপের বাইরেও দেখা গিয়েছিল। ১১০৯ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হওয়া রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধ ১৮১৫ সালে নেপোলিয়নের দ্বিতীয় পরাজয়ের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়। সেই হিসাবে, অ্যাংলো-ফরাসি যুদ্ধ ৭০৬ বছর ৫ মাসের কিছু বেশ সময় ধরে চলেছে। ধারাবাহিক এ যুদ্ধের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য লড়াই ছিল এগিনকোর্ট, ক্রেসি ও ওয়াটার লু। নেপোলিয়নের নেতৃত্বাধীন ফরাসি সাম্রাজ্যের যোদ্ধারা ইউরোপীয় সম্মিলিত শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করার মধ্য দিয়ে যুদ্ধের দামামা থামে।
রোমান-পার্সিয়ান যুদ্ধ : বিশ্বের প্রাচীন দুই প্রভাবশালী সাম্রাজ্যের একটি রোমান, অন্যটি পারস্য। এ দুই সাম্রাজ্য ৬৮১ বছর ধরে একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। যুদ্ধের সূচনা হয় ৫৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে এসে। ৫৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রোমান জেনারেল মার্কাস ক্রাসাসের মেসোপটেমিয়া আক্রমণের মধ্য দিয়ে এ যুদ্ধের উত্তেজনা ছড়ায়। আর এ পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় মিথ্রিডেটস ও লুসিয়াস কর্নেলিয়াস সুল্লার মধ্যে মৈত্রী আলোচনা ব্যর্থ হওয়ায় পরের বছর যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে পূর্ব রোমের সম্রাট হেরাক্লিয়াস ও তাঁর ভাই থিওডোর পারস্য সাম্রাজ্যের ওপর বড় রকমের আঘাত হানতে সক্ষম হন। পরে পারস্য শাসকেরা সফল শান্তি আলোচনা সম্পাদন করেন। এ যুদ্ধের প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনগুলো শতাব্দী পেরিয়েও যুদ্ধকৌশলে প্রভাব রেখে গেছে।
বাইজেনটাইন-বুলগেরীয় যুদ্ধ : বাইজেনটাইন বা পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য ও বুলগেরিয়ার মধ্যে এ যুদ্ধ হয়েছিল। যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে। ওই সময় বুলগেরিয়ার শাসক খান আসপারুহ তাঁর সেনাদের নিয়ে দানিয়ুব নদী পেরিয়ে বাইজেনটাইন ভূখণ্ডে ঢুকে পড়েন ও নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। সেই যে যুদ্ধ শুরু, ১৩৫৫ খ্রিষ্টাব্দে এসে তার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে। দিনপঞ্জির পাতায় তত দিনে সাড়ে ৬ শতকের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে সময়টা ৬৭৫ বছর। ১৩৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ধারাবাহিক এ যুদ্ধের শেষ পর্বে বুলগেরিয়া জয় পেয়েছিল। যদিও অল্প সময়ের মধ্যে অটোম্যান সাম্রাজ্যের উত্থানে বাইজেনটাইন ও বুলগেরিয়া উভয় সাম্রাজ্যের অবসান হয়।
ক্রুসেড : ক্রুসেডকে বলা হয় ধর্মযুদ্ধ। ১০৯৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৬৯৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ক্রুসেড ঘটেছে। ইউরোপের খ্রিষ্টান রাজ্যগুলোর শাসকেরা ওই সময় মধ্যপ্রাচ্যের লেভান্ত বা পূর্বাংশের মুসলিম-নিয়ন্ত্রিত ভূমি দখলে নেওয়ার অভিযানে নামলে ক্রুসেড শুরু হয়। ক্রুসেডের সময় মুসলিম শাসকদের কাছ থেকে জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করা ইউরোপীয়দের বড় লক্ষ্য ছিল। তবে ক্রুসেডের প্রভাব যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় ৬০৪ বছর ধরে চলা লড়াই, চরম অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তার পর ক্রুসেড থামে।
আরব-বাইজেনটাইন যুদ্ধ : ইতিহাসের অন্যতম প্রভাব বিস্তারকারী যুদ্ধগুলোর একটি আরব-বাইজেনটাইন যুদ্ধ। এ যুদ্ধ ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে কার্যত ভৌগলিক সীমা টেনে শেষ হয়েছিল। আর এ সীমার জের শতাব্দীর পর শতাব্দী টেনে নিয়ে চলেছে কোটি কোটি মানুষ। অর্থনৈতিক, ভূরাজনৈতিক ও ধর্মীয়—তিন ক্ষেত্রেই আরব-বাইজেনটাইন যুদ্ধের প্রভাব ব্যাপক। যা–হোক, এ যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে, আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়েছিল ১০৫০ খ্রিষ্টাব্দে এসে। অর্থাৎ আরব-বাইজেনটাইন যুদ্ধ চলেছিল চার শতাব্দীর বেশি সময় বা প্রায় ৪২১ বছর।
ইয়েমেনি-অটোম্যান সংঘাত : ইয়েমেন ও অটোম্যান শাসকদের এ সংঘাত চলেছিল ৩৭৩ বছর। শুরু হয় ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দে, শেষ ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে। পুরো আরব উপদ্বীপে সাম্রাজ্য বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা ছিল প্রতাপশালী অটোম্যান শাসকদের। তবে বাধ সাধেন ইয়েমেনের শাসকেরা। ফলাফল, শতকের পর শতক সংঘাত। অটোম্যানদের পক্ষ থেকে দ্বিতীয় সেলিম ও প্রথম সুলেইমানের মতো গভর্নররা সাফল্যের মুখ দেখেন। ইয়েমেন ও এর আশপাশে অটোম্যান প্রভাব নিশ্চিত হয়। অটোম্যানদের অধীন ইয়েমেনের স্বায়ত্তশাসনের শর্তজুড়ে দিয়ে এক চুক্তিতে ১৯১১ সালে সংঘাত থামে। যদিও কয়েক বছরের মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এই চুক্তি অকার্যকর হয়ে পড়ে।
মরক্কো-পর্তুগাল সংঘাত : পর্তুগালের সম্রাট ও মরক্কোর রাজাদের মধ্যে ধারাবাহিক সংঘাতের সূচনা হয়েছিল ১৪১৫ খ্রিষ্টাব্দে। শেষ হয় ১৭৬৯ খ্রিষ্টাব্দে। প্রায় ৩৫৪ বছর ধরে একের পর এক সংঘাতে জড়ায় দুই পক্ষ। ভূমধ্যসাগরের পশ্চিমাঞ্চলে মরক্কোর নৌশক্তিকে হটিয়ে পর্তুগালের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা ছিল সংঘাতের আসল লক্ষ্য। পর্তুগালের রাজা সেবাস্তিয়ান যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে মরক্কোর ভূখণ্ড থেকে পর্তুগিজ সেনা প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে সংঘাতের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে।
রুশ-তুর্কি যুদ্ধ : রুশ সাম্রাজ্য আর অটোম্যান সাম্রাজ্যের মধ্যে সংঘটিত ১২টি সংঘাতকে একযোগে রুশ-তুর্কি যুদ্ধ বলা হয়। ১৫৬৮ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয়ে এ যুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে থামে ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে এসে। অর্থাৎ যুদ্ধ চলেছিল প্রায় ৩৫০ বছর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে জার্মানির বিরুদ্ধে জোট গড়ে ব্রিটেন ও রাশিয়া। এ জোটে তুরস্কও ছিল। সই হয় চুক্তি। ইতিহাসে এটা ব্রেস্ট-লিটভস্ক চুক্তি (১৯১৮) নামে পরিচিত। এ চুক্তির মধ্য দিয়ে রাশিয়া ও তুরস্কের সাড়ে তিন শতকের সংঘাত ও সব বিরোধিতার অবসান ঘটে। তথ্যসূত্র : ওয়ার্ল্ডঅ্যাটলাস ও ব্রিটানিকা