গাজায় যুদ্ধবিরতিতে সম্মত 

ইসরায়েল না হামাস—কে জিতল, কে হারল

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
  ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৫২

টানা ১৫ মাস লড়াই শেষে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হলো ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। যুদ্ধবিরতির আওতায় গাজায় অবশিষ্ট ইসরায়েলি জিম্মি ও ইসরায়েলের কারাগারে থাকা ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হবে, বলছেন মধ্যস্থতাকারীরা।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গত মঙ্গলবার পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেননি। তবে এ যুদ্ধবিরতি ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে স্মরণকালের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ও বিধ্বংসী লড়াইয়ের অবসান ঘটাতে পারে। এ এমন এক লড়াই, যা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ছাপিয়ে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব ফেলেছে। পাশাপাশি এ লড়াই কয়েক দশক ধরে চলতে থাকা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বকে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে কূলকিনারাহীন অস্থিরতার একেবারে প্রাণকেন্দ্রে নিয়ে এসেছে।
যুদ্ধে ইসরায়েল কৌশলগতভাবে নানা সাফল্য অর্জন করার দাবি করতে পারে, যেমন ইসমাইল হানিয়াসহ হামাসের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের হত্যা, হামাসকে সমর্থন দেওয়া লেবাননের হিজবুল্লাহর ওপর, এমনকি ইরানে আক্রমণ চালিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মেরে ফেলা ও ক্ষতিসাধন করা ইত্যাদি। কিন্তু ইসরায়েল তার প্রধান দুই লক্ষ্য হাসিল করতে ব্যর্থ হয়েছে।
খাবার বিতরণ কেন্দ্রে ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের হুড়োহুড়ি। খান ইউনিস, গাজা, ফিলিস্তিন, ৯ জানুয়ারি ২০২৫ছবি: এপি
এ যুদ্ধে ইসরায়েল কৌশলগতভাবে নানা সাফল্য অর্জন করার দাবি করতে পারে, যেমন ইসমাইল হানিয়াসহ হামাসের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের হত্যা, হামাসকে সমর্থন দেওয়া লেবাননের হিজবুল্লাহর ওপর, এমনকি ইরানে আক্রমণ চালিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মেরে ফেলা ও ক্ষতিসাধন করা ইত্যাদি।
কিন্তু ইসরায়েল তার প্রধান দুই লক্ষ্য হাসিল করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর একটি, হামাসকে নির্মূল করা। অন্যটি, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হাতে জিম্মি হওয়া সব ইসরায়েলিকে ফেরত আনা। গাজায় বিরামহীন নিষ্ঠুর হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ইসরায়েল ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠনটিকে অনেকটাই দুর্বল করতে পেরেছে, কিন্তু তারা আজও টিকে আছে। আবার গাজায় আটক জিম্মিদের কেউ কেউ ইসরায়েলি বাহিনীর হামলাতেই নিহত হয়েছেন। কাউকে কাউকে হামাস নিজে থেকে মুক্তি দিয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে ইসরায়েলি সেনাদের অগ্রযাত্রার মুখে কিছু জিম্মিকে হামাস হত্যা করেছে।
গাজায় থাকা অবশিষ্ট জিম্মিদের দেশে ফিরিয়ে আনাকে নিজেদের ‘পবিত্র কর্তব্য’ হিসেবে দেখছে ইসরায়েল। এ কর্তব্য পালন করতে গিয়ে একতরফা চুক্তি মেনে বিপুলসংখ্যক ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেওয়ার ‘যন্ত্রণা’ সইতে হবে তাকে। এর আগে কয়েক মাস ধরে আলোচনার পরও চুক্তি করতে না পারায় ইসরায়েলের ভেতরেও ক্ষতি হয়েছে অনেক।


প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু হামাসের সঙ্গে যুদ্ধে ‘সার্বিক বিজয়’ অর্জন ও গাজা থেকে সব জিম্মিকে দেশে ফেরানোর অঙ্গীকার করেছিলেন, তবে সেসব হয়নি। বিপরীতে দেশের অভ্যন্তরে ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে তাঁকে। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ছিলেন কিছু জিম্মির পরিবারের সদস্যরাও। নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে সমালোচকদের অভিযোগ, জিম্মিদের দ্রুত ফিরিয়ে আনার বদলে তিনি নিজের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করে চলেছেন। যদিও এসব অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন তিনি।
ইতিমধ্যে গাজায় ইসরায়েলের নৃশংস অভিযান বিশ্বজুড়ে দেশটিকে নিয়ে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বিচারালয় (আইসিজে) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর অভিযোগ খতিয়ে দেখছেন। আর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত থাকার অভিযোগে নেতানিয়াহু, তাঁর সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং হামাসের একজন শীর্ষস্থানীয় কমান্ডারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন।
হামাস বলেছে, ইসরায়েলে ৭ অক্টোবরের হামলার লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা ও স্বাধীনতার ইস্যুকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিগোচরে নিয়ে আসা, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে অব্যাহত দখলদারি চালিয়ে যাওয়ায় ইসরায়েলকে শাস্তি দেওয়া ও দেশটির কারাগারে বন্দী নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ফিরিয়ে আনা। ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে হামাস তাদের প্রত্যাশিত ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর কাড়তে পেরেছে।
গাজার ধ্বংসস্তূপের মাঝেও হামাস টিকে আছে
হামাস বলেছে, ইসরায়েলে তাদের ৭ অক্টোবরের হামলার লক্ষ্য ছিল, ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা ও স্বাধীনতার ইস্যুকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিগোচরে নিয়ে আসা, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে অব্যাহত দখলদারি চালিয়ে যাওয়ায় ইসরায়েলকে শাস্তি দেওয়া ও দেশটির কারাগারে বন্দী নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ফিরিয়ে আনা।
ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে হামাস তাদের প্রত্যাশিত ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর কাড়তে পেরেছে। তবে এর জেরে গাজায় ইসরায়েল যে তাণ্ডব শুরু করেছে, তাতে ফিলিস্তিনিদের বিপর্যয়কর মূল্য দিতে হয়েছে। এ মূল্য এমনই যে কোনো কোনো পরিবারের সবাই ইসরায়েলি বোমায় নিহত হয়েছেন, কেউ স্বামী-সন্তান-বাবা হারিয়েছেন, বাড়ির পর বাড়ি-স্কুল-হাসপাতাল ধ্বংস হয়েছে। সব মিলিয়ে নিহত ৪৬ হাজার মানুষ। তাঁদের বড় অংশই নারী ও শিশু। আর এ উপত্যকা পরিণত হয়েছে এক নরকপুরিতে। যত দূর চোখ যায় শুধু ধ্বংসস্তূপের প্রতিচ্ছবি।
ইসরায়েলের দাবি, যুদ্ধে তারা ১৭ হাজারের বেশি হামাসের যোদ্ধাকে হত্যা করেছে। যদিও এর পক্ষে কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি দেশটি।
জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের হিসাবে, ইসরায়েল-হামাস ১৫ মাসের যুদ্ধে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দার ১৯ লাখই; শতকরা হিসেবে যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশ। বাস্তুচ্যুত এসব মানুষের একটি বড় অংশ ক্ষুধা ও রোগশোকের সঙ্গে লড়াই করছে; যাদের থাকতে হচ্ছে অস্থায়ী তাঁবুতে, ভীষণ রকমের অস্বাস্থ্যকর ও মানবেতর জীবনে।
ইসরায়েলের আগ্রাসন ও হামলায় গাজায় হামাসের শীর্ষস্থানীয় নেতারা নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া সংগঠনের মধ্যম সারির বেশ কয়েকজন কমান্ডার নিহত হয়েছেন ইসরায়েলি সেনাদের সঙ্গে লড়াইয়ে। হামাসের রকেটের মজুতও অনেকটা ফুরিয়ে এসেছে। ধ্বংস হয়ে গেছে বেশ কয়েকটি ভূগর্ভস্থ টানেল।
এত কিছুর পরও হামাস প্রভাবশালী সশস্ত্র সংগঠন হিসেবে নিজেকে টিকিয়ে রেখেছে ও ইসরায়েলি সেনাদের ওপর প্রাণঘাতী সব হামলা চালাচ্ছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এ সপ্তাহে বলেছেন, যুদ্ধে হামাস যত যোদ্ধা হারিয়েছে, তার প্রায় সমসংখ্যক যোদ্ধাকে নতুন করে নিয়োগ দিয়েছে তারা।
দৃশ্যত হামাসকে শেষ করা ইসরায়েলের পক্ষে সম্ভব নয়। এমনকি ইসরায়েলের সঙ্গে লড়াইয়ে টিকে যাওয়া ও দেশটির কারাগার থেকে ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্ত করে আনার পর সংগঠনটির জনপ্রিয়তা বাড়তে পারে। ৮০–এর দশকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সশস্ত্র সংগঠন হামাস ফিলিস্তিনি সমাজের সঙ্গে গভীরভাবে মিশে গেছে। গাজা ছাড়াও তার শক্ত উপস্থিতি রয়েছে পশ্চিম তীর ও লেবাননের শরণার্থীশিবিরগুলোতে।
বাইডেনের জন্য মাথাব্যথার, ট্রাম্পের জন্য বিজয়ের
গাজাযুদ্ধের জেরে বিশ্বজুড়ে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভ হয় যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে। বিভক্তি দেখা দেয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ডেমোক্রেটিক পার্টির অভ্যন্তরে। পুরো বিষয় গত নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ে অবদান রাখে।
ইসরায়েলি সমর্থকেরা তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রশংসা করেন। তবে সমালোচকেরা নেতানিয়াহুর দুষ্কর্মে সমর্থন প্রদান ও ইসরায়েলকে অস্ত্র সহায়তা দিয়ে এ যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করায় বাইডেনের নিন্দা জানান।
গাজায় যুদ্ধবিরতির উদ্‌যাপনের মধ্যেই ইসরায়েলের হামলা, নিহত ৩
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুক্তি দিতে পারেন, নির্বাচনের আগেই তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, শপথ গ্রহণের আগে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ বন্ধ করবেন। তাঁর সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হয়েছে।
স্টিভ উইটকফ ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত। তিনিও যুদ্ধবিরতিতে নিজস্ব পরিমণ্ডলে থেকে মধ্যস্থতা করেছেন। উইটকফ বলেন, ট্রাম্পের নির্বাচন যুদ্ধবিরতি প্রক্রিয়াকে গতিশীল করেছে। যদিও বাইডেন প্রশাসন বলছে, কয়েক মাস ধরে তাঁর নিবিড় প্রচেষ্টার ফলই হলো এ যুদ্ধবিরতি।