রুশ ‘জ্বালানি অস্ত্রে’ বিপর্যস্ত ইউরোপ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
  ১৯ জুলাই ২০২২, ১৪:৫৯

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরই শুধু নয়, এর আগে থেকেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে যে, দেশটি পুরো ইউরোপকে শায়েস্তা করার অভিপ্রায়ে জ্বালানি ‘ফাঁদ’ বা ‘হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করছে। এ অভিযোগ অবশ্য বরাবরই প্রত্যাখ্যান করে আসছে মস্কো। ১১ জুলাই বাল্টিক সাগর তলদেশ হয়ে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের পাইপলাইন নর্ড স্ট্রিম ১ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ নিয়ে দ্য গার্ডিয়ানে ইউরোপের ভোগান্তি ও ভবিষ্যৎ জ্বালানি চিন্তা নিয়ে বিশেষ প্রবন্ধ লিখেছেন ব্রিটিশ দৈনিকটির জ্বালানি প্রতিনিধি অ্যালেক্স লসন। 
পুতিন কি আদৌ আবার ট্যাপ চালু করবেন? ক্রেমলিন নিয়ন্ত্রিত শক্তি সংস্থা গ্যাজপ্রম ২১ জুলাই পর্যন্ত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নর্ড স্ট্রিম ১ পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। এরই মধ্যে সক্ষমতার ৪০% সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ এই যে, রাশিয়ার
প্রেসিডেন্ট এই পাইপলাইন পুনরায় সক্রিয় করতে অস্বীকৃতি জানাতে পারেন।
সম্প্রতি অক্সফোর্ডে অরোরা আয়োজিত সম্মেলনে জ¦ালানি নির্বাহীদের প্রশ্ন করা হয়েছিল, রাশিয়া কি সরবরাহ প্রক্রিয়া পুনরায় সক্রিয় করতে পারে? আত্মবিশ্বাসী নির্বাহীরা ‘হ্যাঁ’ বলে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু প্রায় সমানসংখ্যক নির্বাহীর আশঙ্কা ‘না’। আসল উত্তর একমাত্র পুতিনই জানেন।
গ্যাস সরবরাহ নিয়ে আশঙ্কা থেকে ইউরোপীয় দেশগুলো শীত নামার আগেই তাদের মজুদ মজবুত করেছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির চিফ অব স্টাফ অ্যান্ড্রি ইয়ারমাক অভিযোগ করেছেন, রাশিয়া ‘গ্যাস ফাঁদ’ পেতে বসেছে। তবে বেলারুশ ও তুরস্কসহ রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা দেশগুলো তেমন কোনো ‘বিঘœ’ দেখছে না।
ইউক্রেনের সঙ্গে বিরোধের জেরে ইউরোপে গ্যাসপ্রবাহ সীমিত করার অতীত আছে রাশিয়ার। ২০০৫-০৬, ২০০৯ ও ২০১৭ সালে যেমনটা দেখা গেছে। কিন্তু ¯œায়ুযুদ্ধের সময়ও যেহেতু ক্রেমলিন সরবরাহ অব্যাহত রেখেছিল, এ জন্য জ¦ালানি খাতের অনেকেই মনে করছেন, রাশিয়া এখন এত বড় বাজার নষ্ট করবে না। তবে, শেলের নির্বাহী বেন ভন বুরডেন বলছেন, পুতিন দেখিয়ে দিয়েছেন যে, ‘তিনি জ¦ালানি সরবরাহকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চান এবং এটা করতে তিনি সক্ষমও।’
এই কৌশলের আপাত লক্ষ্য হলো : কিয়েভের মিত্রদের দুর্বল করা এবং দেশগুলোর মধ্যে এক ধরনের দ্বন্দ্ব বাঁধানো। হাঙ্গেরির পুতিনপন্থি প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান যেমনটা বলেছেন, প্রতিবেশীদের কাছে তার দেশ গ্যাস রপ্তানি বন্ধ করবে। এমন পদক্ষেপ ২০১৭ সালের রাশিয়া-ইউক্রেন গ্যাস বিরোধের জেরে সরবরাহ হ্রাস রোধ করতে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে বাধ্যতামূলক সংহতির লঙ্ঘন।
ইউরোপে কম গ্যাস বিক্রির অর্থ ক্রেমলিনের যুদ্ধ করার অর্থ কমে যাবে। এ কথা মাথায় রেখে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) বছরের শেষ নাগাদ রুশ আমদানি দুই-তৃতীয়াংশ কমাবে বলে মনস্থির করেছে। তবে ইইউ নেতারা রুশ তেলের ওপর আংশিক নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে সম্মত হলেও, রুশ গ্যাসের ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা অসম্ভাব্য বলে মনে হচ্ছে।
পুতিন স্ক্রু ঘুরিয়ে দেওয়ায় কোনো কোনো দেশ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ?
জার্মানি হলো ইউরোপের অর্থনৈতিক শক্তিঘর। নর্ড স্ট্রিম ১ বন্ধ হওয়ার পর রুশ গ্যাসের আকস্মিক অভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই দেশটি। জার্মানি ২০২১ সালে নর্ড স্ট্রিম ১-এর মাধ্যমে ৫৯.২ বিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস আমদানি করেছিল। নতুন পাইপলাইন নর্ড স্ট্রিম ২-এর মাধ্যমে এটি দ্বিগুণ করার আশা করেছিল তারা, কিন্তু ইউক্রেন আক্রমণের কয়েকদিন আগে সেই পরিকল্পনাগুলো স্থগিত করেছিল।
ইতালীয়রা বর্তমানে তাপপ্রবাহের সাথে লড়াই করছে কিন্তু ইউরোপের সবচেয়ে বয়স্ক জনসংখ্যার দেশটিতে এই শীতে উষ্ণ থাকাটাই এজেন্ডায় বেশি। সেøাভাকিয়ার প্রধান গ্যাস আমদানিকারক কোম্পানি এসপিপি বেশিরভাগ গ্যাস সংগ্রহ করে রাশিয়া থেকে। এমনকি [ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট] জেলেনস্কিও স্বীকার করেন, সেøাভাকরা অবিলম্বে সেই উৎসটি বন্ধ করতে পারে না।
অস্ট্রিয়া তার গ্যাসের ৮০% রাশিয়া থেকে পায়। ডাচ জ্বালানি মন্ত্রণালয় বলছে, দেশটি অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য রাশিয়ান গ্যাসের প্রয়োজনীয়তা শেষ করার লক্ষ্য পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। তবে সরবরাহ কমে যাওয়ায় তারাও হোঁচট খাবে।
ফ্রান্স তার কিছু প্রতিবেশীর তুলনায় রাশিয়ার ওপর কম নির্ভরশীল, যেটি তার গ্যাসের প্রায় ১৭% সরবরাহ করে। কিন্তু জ¦ালানির বিকল্প বের করা তাদের জন্যও জটিল। কারণ অনেক ফরাসি পারমাণবিক কেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জন্য বন্ধ রয়েছে। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ সব দিক থেকে দেশের গ্যাস সরবরাহ নিয়ে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার মুখোমুখি হচ্ছেন।
রাশিয়া এপ্রিলের শেষদিকে পোল্যান্ড এবং বুলগেরিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়, যখন তারা রুবেলে অর্থ প্রদানের দাবি মেনে নিতে অস্বীকার করেছিল। পোল্যান্ড তার প্রায় অর্ধেক গ্যাস রাশিয়া থেকে নিত।