বাংলাদেশের রাজনীতি ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন একান্তভাবেই দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়। আর কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের হস্তক্ষেপ সমর্থন করে না ভারত। বিষয়টি ওয়াশিংটনকে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে নয়াদিল্লি।
শুক্রবার ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের ‘টু প্লাস টু’ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনোদ মোহন কোয়াত্রা।
তার এই মন্তব্যের পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার।
ভারতের সংবাদমাধ্যম ‘টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া’র সিনিয়র সাংবাদিক দেবদীপ পুরোহিতের প্রতিবেদনে এমনই তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর তাদের মার্কিন সমকক্ষ- প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন- পঞ্চম ‘টু প্লাস টু’ মন্ত্রী পর্যায়ের এই বৈঠকে অংশ নেন।
বৈঠক শেষে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনোদ মোহন কোয়াত্রা বলেন, “বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতি ও আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা খুবই পরিষ্কারভাবে এই ইস্যুতে আমাদের অবস্থান তুলে ধরেছি।”
তিনি বলেন, “তৃতীয় কোনো দেশের নীতি নিয়ে মন্তব্য করার সুযোগ আমাদের (ভারতের) নেই। বাংলাদেশে নির্বাচন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং বাংলাদেশের জনগণ তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।”
কোয়াত্রার মন্তব্য, “ভারত ‘বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সম্মান করে’- এর মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি নয়াদিল্লির সমর্থন নিশ্চিত করেছে।”
শেখ হাসিনা আগামী বছরের (২০২৪) জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনে চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হতে তার দলকে সরাসরি নেতৃত্ব দেবেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বেশ কিছু পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ মনে করেন- নয়াদিল্লির এই মন্তব্য মার্কিন সংস্থাগুলোকে, বিশেষ করে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের কাছে একটি বার্তা পাঠিয়েছে যে তাদের প্রতিবেশি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়গুলো থেকে দূরে থাকা উচিত।
আওয়ামী লীগ মনে করে, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতের অজুহাতে মার্কিন কর্তৃপক্ষ, বিশেষ করে বাংলাদেশে পিটার হাসের নেতৃত্বাধীন মিশন, দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করছে।
বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত বিগত দুটি সাধারণ নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে “অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের” লক্ষ্যকে সমর্থন করে গত মে মাসে বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন ভিসা নীতির ঘোষণা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এটিকে আমেরিকার ‘নাক গলানো’ বলে মনে করা হচ্ছে।
গত কয়েক মাস ধরে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের আচরণ- যেমন তিনি বিরোধী দলগুলোর সাথে বেশ কয়েকটি বৈঠক করেছেন এবং নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপে বসার কথা বলেছেন। একজন বিদেশি কূটনীতিক হিসেবে তার এই তৎপরতার কারণে ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দলগুলো- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এবং তার শরিক জামায়াতে ইসলামী- পশ্চিমাদের এই তৎপরতার সুযোগ নিচ্ছে এবং নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি পুনর্ব্যক্ত করছে।
এমতাবস্থায়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারত একই অবস্থানে আছে কিনা তা নিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন মহলে নানা জল্পনা ছিল।
তবে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব কোয়াত্রার শুক্রবারের মন্তব্য সব ধরনের জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচিও সম্প্রতি সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে একই ধরনের কথা বলেছিলেন।
সুতরাং নয়াদিল্লির বার্তা- ‘প্রতিবেশি বাংলাদেশের নির্বাচন তার ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’- ভারতের এই দৃষ্টিভঙ্গি বা অবস্থান সুস্পষ্টভাবেই মার্কিন তৎপরতাকে প্রত্যাখ্যান হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, “ভারত বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং অংশীদার। আমরা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সম্মান করি। বাংলাদেশকে স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ করতে ভারত সবসময়েই সহযোগিতা করছে এবং ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে।”
ভারতের এই মন্তব্য গত ২৮ অক্টোবর বিরোধীদের সহিংস বিক্ষোভের পটভূমিতে আসলো বলে মনে করা হচ্ছে। সহিংস ওই বিক্ষোভের সময় একজন পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। হামলা করা হয় প্রধান বিচারপতির বাসভবনেও। সেদিন অনেক সাংবাদিককেও মারধর করা হয়েছে। কিন্তু সহিংস ওই ঘটনাগুলোর ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিন্দা ছিল খুবই সামান্য।
বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও তৃণমূল বিএনপি নামের নতুন রাজনৈতিক দলের সভাপতি শমসের মবিন চৌধুরী বলেছেন, “আমরা ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের বক্তব্যকে স্বাগত জানাই। কারণ স্থিতিশীলতা ও শান্তি বাংলাদেশের জন্য মৌলিক ও অপরিহার্য বিষয়। বাংলাদেশ এই প্রগতিশীল রাজনীতির জন্যই সর্বদা লড়াই করেছে।”
“আমাদের প্রত্যাশা যে নয়াদিল্লির বার্তাটি মার্কিন সরকার ভালভাবে গ্রহণ করেছে,” যোগ করেন তিনি।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া বলেছেন, “তিনি (কোয়াত্রা) আজ যা বলেছেন আমরা তার প্রশংসা করি।”
তিনি বলেন, “আমাদের দেশের পররাষ্ট্র নীতি হলো- সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বিদ্বেষ নয়, যা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রণয়ন করেছিলেন। তিনি (কোয়াত্রা) যা বলেছেন আমরা তার প্রশংসা করি, কেননা এটি আমাদের প্রতি ভারতের সম্মানের বহিঃপ্রকাশ।” সূত্র: টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া