গত কিছুদিন ধরে মিয়ানমারের জাতিগত বিদ্রোহীদের আক্রমণে দিশেহারা দেশটির জান্তা সরকার। বিভিন্ন এলাকা দখলে নিয়েছে বিদ্রোহীরা। এমন পরিস্থিতির মুখে সমর্থন হারাচ্ছেন সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়ে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করা জেনারেল মিন অং হ্লাইং। চাপের মুখে হ্লাইংয়ের (৬৭) বদলে বিকল্প নেতৃত্বের কথা ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন তার কট্টর সমর্থকরা।
মিয়ানমারের পার্বত্য শহর পাইন ও লুইনের মূল চত্বরে মঙ্গলবার ভিড় জমান কয়েক শ মানুষ। তারা সেখানে সন্ন্যাসী পাউক কো তাওয়ের কথা শুনছিলেন। ঐ সন্ন্যাসী বলছিলেন, সামরিক শাসক হ্লাইংয়ের উচিত পদত্যাগ করে তার ডেপুটি জেনারেল সো উইনকে দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া। ২০২১ সালে অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন নির্বাচিত সরকারকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উত্খাত করেছিলেন মিন অং হ্লাইং। এর মাধ্যমে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ উসকে দিয়েছেন তিনি। এ কারণে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক সমালোচনার পাশাপাশি মিয়ানমারের মানুষের ঘৃণাও কুড়িয়েছেন তিনি।
এই জান্তা প্রধানকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন দিয়ে আসছে বৌদ্ধ ধর্মযাজকদের চরম-জাতীয়তাবাদী একটি পক্ষ। আর তাদেরই সমর্থক পাইন ও লুইনের চত্বরে বক্তব্য দেওয়া সন্ন্যাসী পাউক তাও। চত্বরে জড়ো হওয়া ব্যক্তিদের উদ্দেশে সন্ন্যাসী তাও বলেন, জেনারেল সো উইনের মুখের দিকে তাকান। একজন প্রকৃত সৈনিকের মুখ। মিন অং হ্লাইং পেরে উঠছেন না। তার উচিত বেসামরিক ভূমিকায় চলে যাওয়া। পাউক তাওয়ের মতো একই সুরে কথা বলছেন জান্তা সরকারের অন্য সমর্থকরাও, যারা বিরোধীদের দমনে সামরিক বাহিনীর ক্রমাগত অসমর্থতায় হতাশ হয়ে পড়ছেন। তবে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে পাউক রাজি হননি। পাইন ও লুইনে রয়েছে মিয়ানমারের ডিফেন্স সার্ভিস একাডেমি। সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সেখানে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী ও সন্ন্যাসীদের মধ্যে সম্পর্ক নতুন কিছু নয়।
সন্ন্যাসীদের রাজনৈতিক এবং প্রায়শ সরকারবিরোধী আন্দোলনেও সক্রিয় দেখা যায়। ১৯৩০-এর দশকে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৮৮ ও ২০০৭ সালের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহেও তাদের সক্রিয়তা ছিল। সবশেষ ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করেন কেউ কেউ। সন্ন্যাসীর পোশাক ছেড়ে তুলে নিয়েছেন অস্ত্রও। আবার কেউ কেউ সামরিক জেনারেলদের সঙ্গেও কাজ করেছেন। এসব সন্ন্যাসীরা মনে করেন, বৌদ্ধধর্ম ও বার্মিজ সংস্কৃতি উভয়কেই বাইরের প্রভাব থেকে রক্ষা করতে হবে।
২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যে স্থানীয় বৌদ্ধ ও মুসলিম রোহিঙ্গাদের মধ্যে সহিংস সংঘাতের পর চরমপন্থি সন্ন্যাসী উইরাথু ‘মা বা থা’ নামে একটি আন্দোলন বা জাতি ও ধর্ম রক্ষার সংগঠন গড়ে তুলতে সাহায্য করেন। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম মালিকানাধীন ব্যবসা বয়কট করা। তাদের দাবি ছিল, মুসলমানদের হাতে বার্মিজ বৌদ্ধধর্ম নিশ্চিহ্ন হওয়ার ঝুঁকিতে। যদিও মিয়ানমারের মুসলিমরা দেশটির মোট জনসংখ্যার মাত্রা ৮ শতাংশ। যাইহোক, সেই আন্দোলনটি ২০১৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে থেমে যায়, কিন্তু তারা এখনো সামরিক সমর্থন পেয়ে আসছে। জাতিগত সংঘাত উসকে দেওয়ার অভিযোগে এর আগে জেল খাটেন উইরাথু। ২০২০ সালে ফের তাকে জেলে যেতে হয়। কিন্তু এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে সামরিক বাহিনী তাকে মুক্তি দেয়। জান্তা প্রধান অং হ্লাইং তাকে সম্মান ও নগদ অর্থও দেন।
২০২১ সালে অং সান সু চির দলকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর গণতান্ত্রিক শাসন ফেরানোর দাবিতে দেশটিতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। জান্তা সরকার সেই বিক্ষোভকারীদের নির্মমভাবে প্রতিহত করে। জেনারেল হ্লাইং তখন থেকেই নিজেকে বৌদ্ধ ধর্মের একজন ধারকবাহক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করে বৈধতা পাওয়ার চেষ্টা করেন। অভ্যুত্থান সম্পর্কে মিয়ানমারের শীর্ষ ধর্মীয় সংস্থা বৌদ্ধ কাউন্সিল বা ‘রাজ্য সংঘ’ খুব কমই কথা বলেছে। সংঘের কিছু সদস্য নীরবে জেনারেলদের সংযমের কথা বলেছেন বলে মনে করা হয়। কিন্তু এই সংঘের প্রবীণ সন্ন্যাসী সিতাগু সায়াদাও প্রকাশ্যে সামরিক বাহিনীকে সমর্থন করেন। এমনকি মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে রাশিয়ায় অস্ত্র কেনার সফরেও গিয়েছিলেন। অন্য ভিক্ষুরা সামরিক বাহিনীকে সমর্থন দিতে আরো এগিয়ে আসেন। উইরাথুর অনুসারী ওয়াথাওয়া তার নিজ রাজ্য সাগাইংয়ে সশস্ত্র মিলিশিয়া গোষ্ঠী গঠনে সাহায্য করেছেন। সন্ন্যাসীদের রাইফেল চালানোর প্রশিক্ষণেরও ছবিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা যায়।
এদিকে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখলের পর থেকে জান্তা সরকার এখন সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে। জান্তাবিরোধী বিভিন্ন বিদ্রোহী ও সশস্ত্র জাতিগত গোষ্ঠী মিয়ানমারের উত্তর, উত্তরপূর্বাঞ্চল, উত্তরপশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণপূর্বাঞ্চলের শত শত জান্তা ঘাঁটিতে অহরহ হামলা চালাচ্ছে। সামরিক জান্তাবিরোধী একটি বিদ্রোহী জোট উত্তরাঞ্চলের বেশি কিছু অংশ দখল করে নিয়েছে। এর মধ্যে আছে চীন সীমান্ত সংলগ্ন কিছু এলাকাও। তিন গোষ্ঠীর বিদ্রোহী জোট ‘ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ এর সমন্বিত হামলায় বহু এলাকা খুইয়ে মিয়ানমার জান্তা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে । ‘ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ এসব হামলার নেতৃত্ব দিয়েছে। এই জোট তিনটি গোষ্ঠী নিয়ে গঠিত। এগুলো হলো—‘তা’আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি’ (টিএনএলএ), ‘আরাকান আর্মি’ (এএ) এবং ‘মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি’ (এমএনডিএএ)। বিদ্রোহীদের আক্রমণে কোণঠাসা সামরিক বাহিনী। তাদের সমর্থকদের মনে এখন সন্দেহ ও হতাশা তৈরি হচ্ছে। দেশটির জনপ্রিয় এক ব্লগার সম্প্রতি মিন অং হ্লাইংকে ‘অযোগ্য’ বলে অভিহিত করেছেন।
এই জান্তা প্রধানের নেতৃত্বে দেশ ব্যাপকভাবে ‘ক্ষতি ও লজ্জার সম্মুখীন হয়ে পড়েছে’ দাবি করে তিনি বলেন, এর জন্য তাকে মাশুল দিয়ে পদত্যাগ করতে হবে। উত্তরের শান রাজ্যে অনেক এলাকা ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের হাতে চলে যাওয়ার উদাহরণ দেন তিনি। জানা যায়, গত বছরের অক্টোবর থেকে ‘ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ আক্রমণ শুরু করে। তাদের অভিযানে হাজারো সৈন্য যুদ্ধ সরঞ্জামসহ আত্মসমর্পণ করে। চলতি বছরের প্রথম সপ্তাহেও সেনাবাহিনী পিছু হটা অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে ব্রাদারহুডের গোষ্ঠী আরাকান আর্মি চিন ও রাখাইন রাজ্যের বিশাল এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে বেশ কয়েকটি সামরিক ঘাঁটি দখল করে। আরাকান আর্মির হাতে আটক সৈন্য, বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে যাওয়ার ভিডিও দেখা গেছে। বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে সামরিক বাহিনী হেলিকপটারের ওপর নির্ভর করছে। সেইসঙ্গে বিদ্রোহী গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণে চালানো বিমান হামলায় বেসামরিক মানুষের প্রাণ যাচ্ছে।
কাচিন রাজ্যের বিদ্রোহীরা জানিয়েছে, এ মাসে তারা একটি হেলিকপটার ও একটি যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছে। সেনারা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাচ্ছে। হাজারো সেনা বিনা লড়াইয়ে আত্মসমর্পণ করেছে। শান রাজ্যে পরাজিত ছয় জেনারেল দেখা গেছে আটককারীদের সঙ্গেই নাশতা খেতে। আটক হাওয়ার পর লাঞ্ছিত হওয়ার চেয়ে তাদের অবয়বে স্বস্তিই বেশি দেখা গেছে। অপরদিকে বিদ্রোহীদের হাতে আটকদের সামরিক বাহিনীতে হস্তান্তরের পর তিন জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অপর তিন জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে, যাতে অন্য সেনারা ভয়ে পিছু হটে চলে না আসে। বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানের ৭৫ বছরের দীর্ঘ ইতিহাসে এ ধরনের বিপরীত ঘটনা নজিরবিহীন। জান্তার পদে পদে মনোবল ভেঙে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে সেনা নিয়োগও কঠিন হয়ে উঠেছে।