ইইউর নতুন অভিবাসন নীতিতে সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে বাংলাদেশিরা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
  ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:৫৯


ইউরোপের অভিবাসন ব্যবস্থা নতুন এবং কঠোর এক অধ্যায়ে প্রবেশ করতে চলেছে। অবৈধভাবে ইউরোপে অবস্থানকারীদের দ্রুত ফেরত পাঠাতে এবং আশ্রয় প্রক্রিয়া সহজে প্রত্যাখ্যানযোগ্য করতে ইউরোপীয় কাউন্সিল তাদের অবস্থান চূড়ান্ত করেছে। নতুন এই নীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো একটি যৌথ ‘নিরাপদ দেশ’ তালিকা প্রণয়ন, যার মধ্যে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই তালিকা ভবিষ্যতে ইউরোপে আশ্রয় চাইতে আসা বাংলাদেশিদের জন্য কঠিনতম পরিস্থিতি তৈরি করবে।‌
সোমবার (৮ ডিসেম্বর) ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাউন্সিল সদস্য রাষ্ট্রগুলোতে অবৈধভাবে অবস্থানরত ব্যক্তিদের প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া দ্রুত এবং সরলীকরণের জন্য একটি ইইউ আইনের ওপর অবস্থান চূড়ান্ত করেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা ইউরোপীয় সীমান্তের বাইরে ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র খোলার অনুমোদন দিয়ে অভিবাসন ব্যবস্থা সংস্কারের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছেন, যেখানে আশ্রয় আবেদন প্রত্যাখ্যাত অভিবাসীদের পাঠানো যেতে পারে। 
এই সিদ্ধান্তটি একটি আইনী প্যাকেজের অংশ যা প্রত্যাখ্যান পাওয়ার পরেও যারা ইউরোপীয় অঞ্চল ত্যাগ করতে অস্বীকার করে তাদের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করে। তবে আগামী মাসগুলোতে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ভোট না দেওয়া পর্যন্ত এই ব্যবস্থা কার্যকর হবে না ।
কাউন্সিলের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নতুন নীতির ফলে যে কোনও সদস্য রাষ্ট্রে আশ্রয় প্রার্থী যদি এমন কোনও দেশ থেকে আসে যেটিকে ইইউ নিরাপদ মনে করে, তবে তার আবেদন দ্রুত ও প্রাথমিক পর্যায়েই প্রত্যাখ্যান করা যাবে। ফলে বাংলাদেশি আশ্রয় চাইতে আসা ব্যক্তিদের আর আগের মতো দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় নিজেদের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার সুযোগ থাকছে না। আশ্রয় আইনজীবীরা বলছেন, এতে আন্তর্জাতিক সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার কার্যত সংকুচিত হয়ে যাবে।
নতুন রিটার্ন রেগুলেশন কেবল দ্রুত প্রত্যাখ্যানই নয়, ফেরত পাঠানোর কঠোর ব্যবস্থাও তৈরি করছে। অবৈধভাবে অবস্থানকারী ব্যক্তিদের পরিচয়পত্র প্রদান, বায়োমেট্রিক তথ্য দেওয়া এবং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাধ্যতামূলক সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। ফেরত আদেশ অমান্য করলে কাজের অনুমতি, আর্থিক সুবিধা বন্ধ হওয়া ছাড়াও কারাবাসের ঝুঁকি তৈরি হবে। এমনকি নিরাপত্তা ঝুঁকির অভিযোগ থাকলে ১০ বছরের বেশি অথবা অনির্দিষ্টকালের জন্য ইউরোপে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা সম্ভব হবে। এই অবস্থান পাল্টালে বা অন্য দেশে পালিয়ে গেলেও রেহাই নেই কারণ ‘ইউরোপীয় রিটার্ন অর্ডার’ (ইআর‌ও) চালু হলে এক দেশে দেওয়া ফেরত আদেশ সব ইইউ দেশে একযোগে কার্যকর হবে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো, অবৈধভাবে থাকা বা প্রত্যাখ্যাত আশ্রয়প্রার্থীদের তৃতীয় দেশে পাঠানোর পথ আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেওয়া। নতুন নীতিতে বলা হয়েছে, ইইউ বা যেকোনও সদস্য রাষ্ট্র তৃতীয় কোনও দেশের সঙ্গে চুক্তি করে ‘রিটার্ন হাব’ স্থাপন করতে পারবে। এই হাবগুলোতে ইউরোপে আশ্রয় না পাওয়া ব্যক্তিদের সাময়িকভাবে রাখা হবে এবং সেখান থেকেই তাদের নিজ দেশে বা অন্য কোনও দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে। 
তবে এই নীতির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। তাদের আশঙ্কা, এসব দেশে পাঠানো হলে আবেদনকারীরা বিচারবহির্ভূত ঝুঁকি, বৈষম্য বা অনিশ্চিত অবস্থার মুখে পরতে পারেন। যদিও ইইউ বলছে, এসব চুক্তিতে মানবাধিকার সুরক্ষা মানা হবে, বাস্তবে কতটা তা নিশ্চিত করা যাবে—তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। 
ইইউর দেশগুলো প্রথমবারের মতো একটি যৌথ ‘নিরাপদ দেশের তালিকা’ প্রণয়নে একমত হয়েছে। এই তালিকায় রয়েছে, বাংলাদেশ, কলোম্বিয়া, মিশর, ভারত, কসোভো, মরক্কো, তিউনিশিয়াসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংযুক্ত হতে আবেদনকারী দেশগুলো।‌
নতুন নিয়ম অনুযায়ী, যদি কোন ব্যক্তির নিজ দেশকে ইইউ নিরাপদ বলে বিবেচনা করে, তবে তার আশ্রয় আবেদন খুব দ্রুত প্রত্যাখ্যান করা যাবে। আবেদনকারীর বক্তব্য বিস্তারিতভাবে পর্যালোচনা করার বাধ্যবাধকতা কমে যাবে।দ্রুত ডিটেনশন ও ফেরত পাঠানোর পথ খুলে যাবে। 
বাংলাদেশকে নিরাপদ দেশ বলা হলেও বাস্তবতা ভিন্ন চিত্র তুলে ধরে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিরোধীদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বহুল অভিযোগ, মতপ্রকাশের সীমাবদ্ধতা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে দীর্ঘদিন ধরে উদ্বেগ রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে ‘নিরাপদ’ ঘোষণা করায় অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
তাদের মতে, এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক বিবেচনা ও ইউরোপে অভিবাসন কমানোর কৌশলের অংশ। ফলে যারা সত্যিকারের ঝুঁকি থেকে ইউরোপীয় দেশগুলোতে আশ্রয় চাইছেন, তারাও সহজেই প্রত্যাখ্যাত হবেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন দাবি করছে, নতুন নিয়ম অনিয়মিত অভিবাসন কমাতে এবং আসল ঝুঁকিপূর্ণ মানুষদের সুরক্ষা দিতে সাহায্য করবে।
কিন্তু মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এই নীতি অনেক আবেদনকারীকে প্রাথমিক ধাপেই বাদ দিয়ে দেবে, যা আন্তর্জাতিক সুরক্ষার মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করবে। বিশেষ করে বাংলাদেশি আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। কারণ তাদের অনেকের আবেদন এখনই স্পষ্টতই ভিত্তিহীন বলে বিবেচিত হতে পারে।
এখন বিষয়টি ইউরোপীয় পার্লামেন্টে আলোচনার অপেক্ষায়। অনুমোদন পেলে নীতিগুলো ২০২৬ সাল থেকে কার্যকর হতে পারে। কার্যকর হলে এটি ইউরোপের অভিবাসন ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে, যেখানে বাংলাদেশি আশ্রয়প্রার্থীরা আগের যেকোনও সময়ের তুলনায় বড় ধরণের ঝুঁকি, অনিশ্চয়তা এবং দ্রুত ফেরতের মুখোমুখি হবেন। 
এ ব‌্যাপারে মন্তব‌্য করতে গি‌য়ে লন্ড‌নের ব‌্যা‌রিষ্টার সালাহ উদ্দীন সুমন ব‌াংলা ট্রিবিউন‌কে ব‌লেন, নিঃস‌ন্দে‌হে এ‌টি বাংলা‌দেশি অ্যাসাইলাম প্রত‌্যাশী‌দের জন‌্য বড় দুঃসংব‌াদ।