টানা তৃতীয় বারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে লড়ছেন নরেন্দ্র মোদি। তার রাজনৈতিক উত্থানে একটি বিষয় প্রতিফলিত হয় আর সেটি হলো ভারত ঔপনিবেশিকতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে একটি আত্মবিশ্বাসী এবং পরাশক্তিধর দেশের মর্যাদা পাওয়ার কাছাকাছি অবস্থায় পৌঁছেছে। যদিও সেখানে গভীর বিচ্যুতি রয়েছে। তার সময়ে ধর্মীয় নিপীড়ন এবং ইসলামোফোবিয়া তীব্রভাবে বেড়েছে। চলমান নির্বাচনকে ঘিরে হিন্দু-মুসলিম উত্তেজনা আরো বাড়ছে। সম্প্রতি মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।
ঐ খবরে বলা হয়েছে, অনেকের অভিযোগ বেকারত্বের মতো নীতিগত ইস্যু থেকে সরে প্রধানমন্ত্রী তার হিন্দু-জাতীয়তাবাদী পরিচয় আরো শক্তিশালী করার উপায় হিসেবে সাম্প্রদায়িকতাকে সামনে আনছেন। যা নিয়ে ভারতের সংখ্যালঘুদের মধ্যে, বিশেষ করে ২৩ কোটি মুসলমানের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। অনেকেই বিশ্বাস করেন না যে, মোদি তাদের দিকে নজর রাখছেন। বরং তারা বলছেন যে, তারা প্রান্তিক হয়ে পড়েছেন কারণ প্রধানমন্ত্রী ধর্মনিরপেক্ষ, বহুত্ববাদী ভারতকে তার দলের একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার স্বপ্ন পূরণ করেছেন।
লোকসভা নির্বাচন
‘দ্য স্যাফরন স্টর্ম: ফ্রম বাজপেয়ী টু মোদি’ বইয়ের লেখক সাবা নখভি সিএনএনকে বলেন, তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লড়াইয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজেকে রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রধানের পাশাপাশি একজন প্রধান পুরোহিত হিসেবে নিজের অবস্থান তুলে ধরছেন। তিনি এমন কিছু করেছেন যা আমাদের সব প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আগে ঘটেনি। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের ব্যক্তিত্বের একটি ‘ধর্মীয় প্রার্থনার প্রথা’ তৈরি করেছেন।
বারানসীর এক দোকানদার আকাশ জসওয়াল সিএনএনকে বলেন, অনেকে মনে করেন মোদিই ঈশ্বর। মোদির মতো প্রধানমন্ত্রী আমাদের আর কখনো হয়নি। তিনি ভারতের জন্য, আমাদের জন্য একটি মহান ত্যাগ স্বীকার করেছেন। আমরা চাই, তিনি চিরদিনের জন্য প্রধানমন্ত্রী হন। বারানসীর বিজেপি নেতা দিলীপ প্যাটেলের মতে, মোদি ভারতের ভবিষ্যতের প্রতিনিধিত্ব করেন। তার নেতৃত্বে ভারত আজ শক্তিশালী, সক্ষম এবং আত্মনির্ভর।
লোকসভা নির্বাচন
২০০২ সালে গুজরাটে যখন সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদি। সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে ঐ দাঙ্গায় ১ হাজারের বেশি লোক নিহত হয়েছিল যাদের বেশির ভাগই মুসলিম ছিল। সমালোচকরা মোদিকে সহিংসতার সঙ্গে জড়িত থাকার জন্য অভিযুক্ত করেন। তবে তিনি দৃঢ়ভাবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। সহিংসতার কয়েক মাস পরে বড় সংখ্যাগরিষ্ঠতায় তিনি পুনর্নির্বাচিত হন। কিন্তু সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ জাতিকে গভীরভাবে বিভক্ত করেছে, যা আজও টিকে আছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ক্রিস্টোফ জাফরেলট বলেন, গুজরাটের ঘটনা হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের আরো আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি বড় ব্যবধানে জয়লাভ করে। মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তার প্রশাসন দেশের পরিবহন নেটওয়ার্ককে উন্নত করেছে, নতুন বিদ্যুৎকন্দ্র এবং সামুদ্রিক প্রকল্প তৈরি করেছে, দেশের সামরিক সক্ষমতাকেও শক্তিশালী করেছে। যাতে ভারত বিশ্ব মঞ্চে উন্নতি লাভ করেছে। কিন্তু কিছু পর্যবেক্ষকের মতে, একটি সমস্যাজনক ‘প্যাটার্ন’ও রয়েছে।
নরেন্দ্র মোদি: দ্য ম্যান, দ্য টাইমস বইয়ের লেখক নিলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় বলেন, মোদি হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতি এবং তাদের আদর্শকে জনপ্রিয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের সরকারের শীর্ষ পদে নিযুক্ত করেছিলেন, তাদের আইনে ব্যাপক পরিবর্তন করার ক্ষমতা দিয়েছিলেন, যা দেশে বসবাসকারী ২৩ কোটি মুসলমানদের মধ্যে ভয়ের অনুভূতি তৈরি করেছে। ২০১৯ সালের নির্বাচনে জয় হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ববাদের জন্য। তিনি কাশ্মীরের বিশেষ স্বায়ত্তশাসন মর্যাদা বাতিল করেছিলেন—ফলে ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যটি নয়াদিল্লির সরাসরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।
তিনি অযোধ্যায় ধ্বংস হওয়া বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির তৈরি করেছেন। যা অনেক মুসলমানের জন্য ১৯৯২ সালের রক্তপাতের বেদনাদায়ক স্মৃতি পুনরুজ্জীবিত করেছে, কিন্তু লাখ লাখ হিন্দু ভক্তদের জন্য গর্বের অনুভূতি এনে দিয়েছে। এই বিভক্তি দিল্লির রাস্তায়ও দেখা যায়। বিখ্যাত জামে মসজিদের বাইরে বসে থাকা এক রিকশাচালক সিএনএনকে বলেন, আজকাল হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে অনেক মারামারি হচ্ছে। আমরা সবাই জানি কেন।
আসন্ন নির্বাচনে মোদি স্বাচ্ছন্দ্যে জয়লাভ করবেন বলে ব্যাপকভাবে প্রত্যাশিত, যদিও কিছু বিশ্লেষক বলেছেন যে, দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের সত্যিকারের ভয় রয়েছে। নিলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় বলেন, আমি অবশ্যই দেশে গণতন্ত্রের মানের ক্ষয় দেখতে পাচ্ছি। আমি ভারতে মুসলমানদের বৃহত্তর নিরাপত্তাহীনতা এবং প্রান্তিকতা দেখতে পাচ্ছি। এটি খুব উজ্জ্বল চিত্র নয়। তবে এটিই সম্ভবত সেই পথ, যেটি ভারত বেছে নিতে চলেছে।