২০১৫ সালের জানুয়ারি মাস, সৌদি আরবের ৯০ বছর বয়সী বাদশাহ আবদুল্লাহ তখন হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায়। তার সৎ ভাই সালমান পরবর্তী বাদশাহ হতে চলেছেন- এবং সালমানের প্রিয় ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমান ক্ষমতা গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান, শুধুমাত্র তার নামের আদ্যক্ষর এমবিএস নামে পরিচিত ছিলেন এবং তখন তার বয়স মোটে ২৯ বছর। এই বয়সেই তার নিজ দেশ নিয়ে এক বড় পরিকল্পনা ছিল, যা ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পরিকল্পনা। তবে তার আশঙ্কা ছিল যে নিজের সৌদি রাজপরিবারের ভেতরে থাকা চক্রান্তকারীরা শেষ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে।
তাই ওই জানুয়ারি মাসের এক মধ্যরাতে, তিনি শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে প্রাসাদে ডেকে পাঠান, তার আনুগত্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য। সাদ আল-জাবরি নামের ওই নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে বলা হয়েছিল তার মোবাইল ফোনটি বাইরে একটি টেবিলে রেখে আসতে। এমবিএসও একই কাজ করেন। দুজন তখন একদম একা।
তরুণ যুবরাজ প্রাসাদের গুপ্তচরদের এতটাই ভয় পেতেন যে সেখানকার একমাত্র ল্যান্ডলাইন টেলিফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে তিনি দেয়াল থেকে সকেটটি টেনে খুলে ফেলেন। আল-জাবরির মতে, এমবিএস তখন আলোচনা করছিলেন যে কীভাবে তিনি তার দেশকে ‘গভীর ঘুম’ থেকে জাগিয়ে তুলবেন, যাতে তার দেশ বিশ্বমঞ্চে সঠিক জায়গা করে নিতে পারে।
বিশ্বের সবচেয়ে লাভজনক কোম্পানি, রাষ্ট্রীয় তেল উৎপাদক আরামকোর একটি অংশ বিক্রি করে তিনি তার অর্থনীতিকে তেলের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে বের করে আনতে শুরু করবেন।
তিনি সিলিকন ভ্যালির টেক স্টার্টআপগুলোয় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবেন, যার মধ্যে রয়েছে ট্যাক্সি কোম্পানি, উবার। এরপর সৌদি নারীদের কাজ করার স্বাধীনতা দিয়ে তিনি ষাট লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবেন।
বিস্মিত হয়ে আল-জাবরি যুবরাজকে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষার পরিধি সম্পর্কে বলতে গিয়ে সহজ ভাষায় জানতে চান, আপনি কি আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের কথা শুনেছেন?
তখনই কথোপকথন শেষ করেন এমবিএস। মধ্যরাতের একটি বৈঠক, যা আধা ঘণ্টার মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সেটা তিন ঘণ্টা ধরে চলে। আল-জাবরি ওই ঘর থেকে বেরিয়ে আসার পর তার মোবাইলে বেশ কয়েকটি মিসড কল দেখতে পান।
দীর্ঘ সময় তার কোনো খোঁজ না থাকায় তার সরকারি সহকর্মীরা দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন।
এখানে এমন এক ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে, যিনি সৌদি আরবের ক্ষমতায় অসাধারণ উত্থান লাভ করেছেন। যিনি সৌদি আরব পরিচালনা করেন এবং যার তেল নিয়ন্ত্রণ সবার উপর প্রভাব ফেলেছে। কীভাবে তিনি শত শত প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে ক্রাউন প্রিন্স হয়েছেন, সেই থেকেই এই গল্পের শুরু হয়েছে।
গত এক বছর ধরে, বিবিসির ডকুমেন্টারি নির্মাতা দল সৌদি আরবে এমবিএসের বন্ধু এবং বিরোধী উভয়ের সাথে কথা বলেছে। পাশাপাশি সিনিয়র পশ্চিমা গুপ্তচর এবং কূটনীতিকদের সাথেও কথা বলেছে।
সৌদি সরকারকে বিবিসির এই প্রামাণ্য চিত্রে এবং এই নিবন্ধে করা দাবির জবাব দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তবে তারা কোনও মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন।
সাদ আল-জাবরি সৌদি নিরাপত্তা যন্ত্রের এত উচ্চ পর্যায়ে ছিলেন যে তার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এবং ব্রিটিশ সরকারের আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-সিক্স এর প্রধানদের সঙ্গেও বন্ধুত্ব ছিল।
সৌদি সরকার আল-জাবরিকে একজন অযোগ্য সাবেক কর্মকর্তা বলে অভিহিত করলেও, তিনি দেশটির অন্যতম তথ্যসমৃদ্ধ ব্যক্তি যিনি সৌদি আরবের যুবরাজ কীভাবে দেশ শাসন করেন সেই সম্পর্কে কথা বলার সাহস করেছেন।
তিনি বিবিসিকে যে বিরল সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তাতে আশ্চর্যজনক বহু তথ্য আছে। বিবিসি মূলত সেই ঘটনাগুলোর উপর আলোকপাত করে যা এমবিএস-কে কুখ্যাত করে তুলেছিল।
এর মধ্যে রয়েছে ২০১৮ সালে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোজির হত্যাকাণ্ড এবং ইয়েমেনে এক ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের সূচনা।
এমবিএস-এর বাবা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ায়, ৩৮ বছর বয়সী এমবিএস এখন ইসলামের জন্মস্থান এবং বিশ্বের বৃহত্তম তেল রফতানিকারক দেশের দায়িত্বে রয়েছেন।
তিনি সাদ আল-জাবরির কাছে বলা অনেক যুগান্তকারী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি বাক-স্বাধীনতা দমন, অনেক মৃত্যুদণ্ড দেওয়া এবং নারী অধিকার কর্মীদের জেলে পাঠানোসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো অভিযোগের মুখোমুখি হন।
এক অশুভ সূচনা
সৌদি আরবের প্রথম বাদশাহ এমবিএসের বাবা সালমান-সহ অন্তত ৪২টি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। ঐতিহ্যগতভাবে এই ছেলেরাই পরপর মসনদে বসতেন। ২০১১ এবং ২০১২ সালে তাদের দুজন হঠাৎ মারা গেলে সালমানকে উত্তরাধিকারের সারিতে উন্নীত করা হয়।
রাশিয়ার ক্রেমলিনে কে কার পরে ক্ষমতায় আসতে পারেন, সে দিকে যেমন পশ্চিমা গোয়েন্দারা তীক্ষ্ণ নজর রাখেন, ঠিক সেভাবেই সৌদি মসনদে কে কার পরে বসতে পারেন সেটাও ক্রমশ তাদের আগ্রহের বিষয় হয়ে ওঠে।
এই পর্যায়ে, এমবিএস এতটাই তরুণ এবং অপরিচিত ছিলেন যে তিনি তাদের নজরেই ছিলেন না। “তিনি তুলনামূলকভাবে কিছুটা আড়ালে বেড়ে উঠেছেন”, ২০১৪ সাল পর্যন্ত এমআই-সিক্স এর প্রধান থাকা স্যার জন সাওয়ারস বলছেন। “কারণ তিনি ক্ষমতায় আসীন হবেন এটা কেউ ভাবেনইনি!”
ক্রাউন প্রিন্স এমন এক প্রাসাদে বেড়ে ওঠেন যেখানে খারাপ আচরণের বিরুদ্ধে কোনও শাস্তি ব্যবস্থা ছিল না। থাকলেও খুবই নগণ্য।
তিনি যে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সেটার প্রভাব সম্পর্কে চিন্তা করেন না এবং চিন্তা ছাড়াই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন, প্রাসাদের এমন পরিবেশ তার সেই কুখ্যাত অভ্যাসগুলোর পেছনে ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে সাহায্য করতে পারে। এমবিএস তার কিশোর বয়সে রিয়াদে সর্বপ্রথম কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন, যখন তাকে “আবু রাসাসা” বা “বুলেট বাবা” নাম দেওয়া হয়েছিল।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে, তিনি এক বিচারককে পোস্টে একটি বুলেট পাঠিয়েছিলেন। ওই বিচারক রাজ পরিবারের সম্পত্তির বিরোধে এমবিএস-এর দাবি অগ্রাহ্য করেছিলেন। “তার নির্মমতা আলাদা একটি বৈশিষ্ট্য ছিল”, স্যার জন সাওয়ারস লক্ষ্য করেন। তাকে কেউ ছাড়িয়ে যাবে এটি তিনি পছন্দ করতেন না।
কিন্তু এর মানে এটাও বোঝায় যে তিনি সৌদি আরবে এমন সব পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছেন যা অন্য কোনও সৌদি নেতা করতে পারেননি।
সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পরিবর্তনের মধ্যে একটি হল তিনি বিদেশি মসজিদ এবং ধর্মীয় স্কুলগুলিতে সৌদি অর্থায়ন বন্ধ করে দেন, যে প্রতিষ্ঠানগুলো ইসলামি জিহাদিবাদের প্রজনন ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল।
এই পদক্ষেপ পশ্চিমা দেশগুলোর নিরাপত্তায় বিশাল সুবিধা বয়ে আনে। প্রাক্তন এমআই-সিক্স প্রধান এসব কথা বলেন। এমবিএস এর মা, ফাহদা, একজন বেদুইন উপজাতি নারী এবং তার বাবার চার স্ত্রীর মধ্যে ফাহদাকে সবচেয়ে প্রিয় হিসেবে দেখা হয়।
পশ্চিমা কূটনীতিকদের ধারণা, বাদশাহ সালমান অনেক বছর ধরে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকা ভাস্কুলার ডিমেনশিয়া (ধীরে ধীরে সব ভুলে যাওয়া) রোগে ভুগছিলেন। এবং তিনি যেকোনো সাহায্যের জন্য তার ছেলে এমবিএস-এর মুখাপেক্ষী ছিলেন।
বেশ কয়েকজন কূটনীতিক এমবিএস এবং তার বাবার সাথে তাদের বৈঠকের অভিজ্ঞতার কথা বিবিসির সাথে শেয়ার করেন। যুবরাজ একটি আইপ্যাডে নোট লিখতেন, তারপর সেগুলো তার বাবার আইপ্যাডে পাঠাতেন, তিনি পরবর্তীতে কী বলবেন সে বিষয়ে ধারণা দেয়ার জন্য এই কাজটি করতেন তিনি।
যুবরাজ দৃশ্যত তার বাবার বাদশাহ হওয়ার জন্য এতটাই অধৈর্য ছিলেন যে ২০১৪ সালে তিনি তার চাচা তৎকালীন সম্রাট আবদুল্লাহকে রাশিয়া থেকে প্রাপ্ত একটি বিষযুক্ত আংটি দিয়ে হত্যা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
“আমি নিশ্চিতভাবে জানি না যে তিনি কেবল আস্ফালনের ছলে কথাগুলো বলেছিলেন কিনা, তবে আমরা একে গুরুত্ব সহকারে নিয়েছিলাম,” আল-জাবরি বলেন।
এ নিয়ে সাবেক এক শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, তিনি এমবিএসের একটি গোপনে রেকর্ড করা নজরদারি ভিডিও দেখেছেন, যেখানে বাদশাহকে এই বিষ প্রয়োগের ব্যাপারে এমবিএস-এর অভিপ্রায়ের কথা উঠে আসে।
“তাকে আদালত থেকে নিষিদ্ধ করা হয়, অনেক দিন রাজার সাথে তার হাত মেলানো নিষিদ্ধ ছিল।”
প্রকৃতপক্ষে, বাদশাহ আবদুল্লাহ স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন, যার ফলে ২০১৫ সালে তার ভাই সালমান সিংহাসনে আরোহণ করেন। এমবিএস প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান এবং দায়িত্ব পাওয়ার পর পর তিনি যুদ্ধে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনও সময় নষ্ট করেননি।
ইয়েমেনে যুদ্ধ
দুই মাস পরে যুবরাজ হুথি আন্দোলনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে একটি উপসাগরীয় জোটকে নেতৃত্ব দেন, যারা পশ্চিম ইয়েমেনের বেশির ভাগ অংশ দখল করে নিয়েছিল। এই হুথিদের তিনি সৌদি আরবের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের প্রতিনিধি হিসেবে দেখতেন। কিন্তু এই যুদ্ধ ইয়েমেনে এক মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনে, যেখানে লাখ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়।
“এটি কোনো বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত ছিল না”, এমনটাই বলেছেন স্যার জন জেনকিন্স, যিনি যুদ্ধ শুরুর ঠিক আগে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত ছিলেন।
“একজন সিনিয়র আমেরিকান সামরিক কমান্ডার আমাকে বলেছিলেন যে তাদের ১২ ঘণ্টার নোটিশ দেওয়া হয়েছিল, যা অপ্রত্যাশিত।” সামরিক অভিযানের মাধ্যমে একজন স্বল্প পরিচিত যুবরাজকে সৌদি জাতীয় বীর হিসেবে তুলে ধরা হয়।
তবে, এটি বেশ কয়েকটি বড় ভুলের মধ্যে প্রথম ভুল ছিল বলে তার বন্ধুরাও বিশ্বাস করেন। একই আচরণ পুনরাবৃত্তির একটি চক্রও দেখা দেয়।
যেমন: সৌদি আরব ঐতিহ্যগতভাবে ধীরগতিতে এবং সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। কিন্তু এমবিএস-এর প্রবণতা ছিল এই পদ্ধতিটি বর্জন করা। তিনি আবেগের বশবর্তী হয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে কাজ করতে পছন্দ করতেন।
এবং তিনি কোনো অবস্থাতেই যুক্তরাষ্ট্রের সামনে নতি স্বীকার করতে অথবা একটি পশ্চাৎপদ রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে বিবেচিত হতে চাইতেন না।
আল-জাবরি আরও এগিয়ে গিয়ে অভিযোগ করেন যে এমবিএস তার বাবা বাদশাহ সালমানের স্বাক্ষর জাল করে স্থল সৈন্য পাঠানোর একটি রাজকীয় ডিক্রি জারি করেন। আল-জাবরি বলেন, তিনি ইয়েমেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে হোয়াইট হাউজে আলোচনা করেছিলেন এবং তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সুসান রাইস তাকে সতর্ক করেছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্র শুধুমাত্র একটি বিমান অভিযানকে সমর্থন করবে।
তবে আল-জাবরি দাবি করেন যে এমবিএস ইয়েমেনে আগ্রাসনের বিষয়ে এতটাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে তিনি আমেরিকানদেরও উপেক্ষা করেন।
“আমরা অবাক হয়েছিলাম যে সেখানে স্থল অভিযানের অনুমোদন দিয়ে একটি রাজকীয় ডিক্রি জারি করা হয়েছিল”, আল-জাবরি বলেন। “তিনি সেই রাজকীয় ডিক্রির জন্য বাবার স্বাক্ষর জাল করেছিলেন। রাজা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন।”
আল-জাবরি বলেছেন, তিনি যে উৎস থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এসব অভিযোগ এনেছেন সেগুলো “বিশ্বাসযোগ্য, নির্ভরযোগ্য” এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যুক্ত এবং তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান কর্মকর্তা ছিলেন।
রিয়াদের সিআইএ স্টেশন প্রধানের কথা স্মরণ করে আল-জাবরি বলেন, এমবিএস আমেরিকানদের উপেক্ষা করায় তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তিনি এটাও বলেছেন যে ইয়েমেনে আগ্রাসী অভিযান কখনওই উচিত ছিল না।
এমআই সিক্স-এর সবেক প্রধান স্যার জন সাওয়ারস বলেছেন যে এমবিএস নথি জাল করেছে কি না তা তিনি জানেন না, তবে এটি স্পষ্ট যে ইয়েমেনে সামরিক হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্তটি এমবিএসের ছিল। “এটি তার বাবার সিদ্ধান্ত ছিল না, যদিও তার বাবা এর সঙ্গে জুড়ে যান।”
আমরা আবিষ্কার করেছি যে এমবিএস শুরু থেকেই নিজেকে একজন বহিরাগত হিসেবে দেখতেন– তিনি এমন এক যুবক ছিলেন যার প্রমাণ করার মতো অনেক কিছু ছিল এবং তিনি অন্য কারো নিয়ম মেনে চলতে চাননি, বরং নিজের নিয়মই বহাল রেখেছেন।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলে দায়িত্ব পালন করা কার্স্টেন ফন্টেনরোজ বলেছেন, তিনি যখন যুবরাজের সিআইএ-এর অভ্যন্তরীণ মনস্তাত্ত্বিক প্রোফাইলটি পড়েন, তখন তিনি অনুভব করেন যে সেখানে এই মূল বিষয়টিই নেই।
“তার উপর ভিত্তি করে কোনো প্রোটোটাইপ ছিল না”, তিনি বলেন।
“তার সীমাহীন সম্পদ ছিল। তাকে কখনো ‘না’ বলা হয়নি। তিনিই প্রথম কোনো তরুণ নেতা যিনি এমন একটি প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করছেন, সত্যি বলতে, সরকারের দায়িত্বে থাকা আমাদের অধিকাংশের এই বুড়ো বয়সে তা বোঝা কঠিন।”
নিজের নিয়ম তৈরি করা
২০১৭ সালে এমবিএস একটি বিখ্যাত পেইন্টিং বা চিত্রকর্ম কেনেন। এই বিষয়টি থেকে অনেকটাই ধারণা করা যায় তিনি কেমন চিন্তাধারার মানুষ। ধর্মীয়ভাবে রক্ষণশীল রাষ্ট্র পরিচালনা করলেও তিনি ভয় না পেয়ে নিয়মের বাইরে পদক্ষেপ নিতে পারেন এবং তার ঝুঁকি নেয়ার আগ্রহ রয়েছে।
সর্বোপরি, ক্ষমতার দাপট দেখাতে তিনি পশ্চিমকে ছাড়িয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ২০১৭ সালে, এক ব্যক্তি সৌদি যুবরাজ এমবিএস-এর হয়ে কাজ করার কথা বলে ৪৫ কোটি ডলার ব্যয় করে সালভাতর মুন্ডি নামের ৫০০ বছরের পুরানো পেইন্টিংটি কিনেন, যা এখনো পর্যন্ত বিক্রি হওয়া সবচেয়ে ব্যয়বহুল শিল্পকর্ম।
লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা এই চিত্রকর্মে যিশু খ্রিস্টকে স্বর্গ ও পৃথিবীর কর্তা, বিশ্বের রক্ষাকারী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। ল্যাটিন শব্দ সালভাতর মুন্ডির অর্থ, “বিশ্বের ত্রাণকর্তা”।
ওই নিলামের পর প্রায় সাত বছর ধরে এই শিল্পকর্ম সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। ক্রাউন প্রিন্সের বন্ধু এবং প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির নিয়ার ইস্টার্ন স্টাডিজের অধ্যাপক বার্নার্ড হেইকেল বলেছেন, পেইন্টিংটি যুবরাজের ইয়ট বা প্রাসাদে ঝোলানো আছে বলে গুজব রটেছে।
তবে চিত্রকর্মটি আসলে সু্ইজারল্যান্ডের জেনেভায় একটি সংরক্ষণাগারে রয়েছে এবং এমবিএস এটি সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে একটি জাদুঘরে ঝুলানোর পরিকল্পনা করছেন, যে জাদুঘর এখনো নির্মিত হয়নি।
“আমি রিয়াদে খুব বড় একটি জাদুঘর বানাতে চাই,” হেইকেল এমবিএসকে উদ্ধৃত করে বলেন। “এবং এজন্য আমি একটি অ্যাঙ্কর অবজেক্ট বা প্রধান আকর্ষণীয় বস্তু চাই যা মানুষকে টেনে আনবে, ঠিক মোনালিসার মতো।”
একইভাবে, খেলাধুলা নিয়ে তার পরিকল্পনা দেখেই ধারণা করা যায় তিনি একাধারে অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী একজন মানুষ। সেইসঙ্গে চলমান প্রেক্ষাপট বদলে দিতে ভয় পান না।
বিশ্ব-মানের খেলাধুলায় সৌদি আরব অবিশ্বাস্য হারে ব্যয় করছে- তারা ২০৩৪ সালের ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজনের একমাত্র বিডার। টেনিস এবং গল্ফের জন্য টুর্নামেন্ট আয়োজনের পেছনেও দেশটি কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে– এই পুরো বিষয়টিকে এক কথায় বলা হয়েছে “স্পোর্টসওয়াশিং”!
তিনি মূলত এমন একজন নেতা, পশ্চিমারা তাকে নিয়ে কী ভাবল না ভাবল সেই সব নিয়ে তেমন পরোয়া করেন না। বরং তিনি এর উল্টোটাই করেন, নিজেকে এবং সৌদি আরবকে মহান করার নামে তিনি যা খুশি তাই করেন।
“এমবিএস একজন নেতা হিসেবে তার নিজস্ব ক্ষমতা গড়ে তোলার ব্যাপারে আগ্রহী,” বলেছেন এমআই সিক্স-এর সাবেক প্রধান স্যার জন সাওয়ারস। যিনি এমবিএস-এর সঙ্গে দেখা করেছিলেন৷
“তার এমন ক্ষমতাবান হওয়ার একমাত্র উপায় হলো তার দেশকে ক্ষমতাবান করে গড়ে তোলা। এই লক্ষ্যেই তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন।”
সৌদি কর্মকর্তা হিসেবে আল-জাবরির ৪০ বছরের কর্মজীবন এমবিএসের ক্ষমতার সমন্বয় সাধন থেকে বাঁচতে পারেনি। এমবিএস দায়িত্ব নেওয়ার সাথে সাথে সাবেক ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মাদ বিন নায়েফের চিফ অব স্টাফ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।
এমবিএস ক্ষমতায় এলে তিনি বিপদে পড়তে পারেন বলে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা থেকে খবর পেয়েছিলেন। তবে জাবরি বলেছেন যে এমবিএস তাকে তার পুরানো চাকরি ফেরত দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে হঠাৎ বার্তা পাঠিয়েছিলেন।
“এটি ফাঁদ ছিল – এবং সেই ফাঁদে পা দেইনি,” আল-জাবরি বলেছেন, তিনি নিশ্চিত যে তিনি ফিরে আসলে তাকে নির্যাতন করা হবে, বন্দী করা হবে বা হত্যা করা হবে।
এ কারণে তার কিশোর সন্তান ওমর এবং সারাহকে আটক করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার এবং পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টার অভিযোগ এনে জেলে পাঠানো হয় – যে অভিযোগগুলো তারা অস্বীকার করেছিল।
নির্বিচারে আটক রাখার বিষয়ে জাতিসংঘের সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস ওয়ার্কিং গ্রুপ অন আরবিট্রারি ডিটেনশন তাদের মুক্তির আহ্বান জানিয়ে আসছে।
“সে আমার হত্যার পরিকল্পনা করেছিল”, আল-জাবরি বলেন। “তিনি আমার মরা মুখ না দেখা পর্যন্ত শান্ত হবে না, এতে আমার কোনও সন্দেহ নেই।”
সৌদি কর্মকর্তারা কানাডা থেকে জাবরির প্রত্যর্পণের জন্য ইন্টারপোল নোটিশ জারি করেছে, কিন্তু তারা সফল হননি। তারা দাবি করেছে যে তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে থাকাকালীন বিলিয়ন ডলার দুর্নীতি করেছে এবং এজন্য জাবরি একজন ‘ফেরার অপরাধী’।
যাই হোক, তিনি পরে মেজর-জেনারেলের মর্যাদা পেয়েছিলেন এবং আল-কায়েদার সন্ত্রাসী হামলা প্রতিরোধে সহায়তার জন্য সিআইএ এবং এমআই সিক্স তার প্রশংসা করেছিল।
খাশোগজি হত্যা
২০১৮ সালে ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে জামাল খাশোগজির হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এমবিএস এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন যে তা অস্বীকার করা খুব কঠিন ছিল। ১৫ সদস্যের একটি হত্যাকারী দল বা হিট স্কোয়াড কূটনৈতিক পাসপোর্ট নিয়ে ভ্রমণ করছিলেন এবং ওই দলে এমবিএসের নিজস্ব দেহরক্ষীদের কয়েকজন ছিল।
খাশোগজির মরদেহ কখনো পাওয়া যায়নি এবং ধারণা করা হয় তার শরীরের সব হাড়ও হাড় কাটার করাত দিয়ে টুকরো টুকরো করা হয়েছিল। প্রফেসর হেইকেল হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন পর এমবিএসের সাথে হোয়াটসঅ্যাপ বার্তালাপ করেন। “আমি জিজ্ঞাসা করছিলাম, “এমন ঘটনা কীভাবে ঘটতে পারল?’,”
হেইকেল সেই সময়ের কথা মনে করে বলেন, “আমি মনে হয়েছে তিনি বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পারেননি যে এর প্রতিক্রিয়া এতটা গভীর হতে চলেছে।”
প্রবীণ মার্কিন কূটনীতিক ডেনিস রস কিছুক্ষণ পরেই এমবিএস-এর সঙ্গে দেখা করেন। “তিনি বলেছিলেন যে তিনি এটি করেননি এবং এখানে বড় ধরনের ভুল হয়েছে”, রস বলেন।
“আমি অবশ্যই চেয়েছি তাকে বিশ্বাস করতে, কারণ আমি বিশ্বাস করতে পারিনি যে তিনি এমন হত্যাকাণ্ডের হুকুম দিতে পারেন।”
এমবিএস সব সময় এই চক্রান্তের বিষয়ে তার জানার কথা অস্বীকার করেছেন, যদিও ২০১৯ সালে তিনি বলেছিলেন যে তিনি এর “দায়িত্ব” নেবেন। কারণ অপরাধটি তার দায়িত্বকালেই ঘটেছিল।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছিল যে তিনি খাশোগজির হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন৷
যারা এমবিএসকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন তাদের আমি জিজ্ঞাসা করেছি যে তিনি তার ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছেন কিনা; নাকি খাশোগজির ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়ার বিষয়টি তাকে আরো সাহস যুগিয়েছিল।
“ওই ঘটনার পর তিনি কঠিন শিক্ষা পেয়েছেন,” অধ্যাপক হেইকেল বলেন। “এই ঘটনা তিনি এবং তার দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন এমবিএস, তবে এর ফলে খাশোগজির মতো হত্যাকাণ্ড আর ঘটবে না, এমনটা বলা যায়।”
স্যার জন সাওয়ারস সতর্কতার সঙ্গে সম্মত হয়েছেন যে হত্যাকাণ্ডটি একটি টার্নিং পয়েন্ট বা মোড় ঘোরানো বিষয় ছিল। “আমি মনে করি এই ঘটনা থেকে সে বড় কিছু শিখেছে। যদিও তার ব্যক্তিত্ব আগের মতোই আছে।”
তার বাবা বাদশাহ সালমানের বয়স এখন ৮৮। তিনি মারা গেলে এমবিএস আগামী ৫০ বছর সৌদি আরব শাসন করতে পারবেন। যাই হোক, তিনি সম্প্রতি স্বীকার করেছেন যে তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে পারেন বলে আশঙ্কা আছে। সম্ভবত সৌদি-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ এমনটা হতে পারে।
অধ্যাপক হেইকেল বলেছেন “আমার ধারণা এমন অনেকেই আছে যারা তাকে হত্যা করতে চায়… এবং তিনি এটি জানেন!”
সারা জীবন সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরা এমবিএসের মতো একজন ব্যক্তিকে সুরক্ষিত রাখতে পারে। এমবিএসের ক্ষমতায় উত্থানের শুরুতে এই বিষয়টি লক্ষ্য করেছিলেন, সাদ আল-জাবরি।
যখন তিনি তার সাথে কথা বলার আগে প্রাসাদের দেওয়ালে থাকা টেলিফোন সকেটটি টেনে খুলে ফেলতে দেখেছেন। এমবিএস এখনও তার দেশকে আধুনিকীকরণের অভিযানে নামা একজন ব্যক্তি, যেসব কাজ তার পূর্বসূরিরা কখনো করার সাহস করতেন না।
তবে তিনি দেশটির একমাত্র স্বৈরাচারী নন, যিনি এতটা নিষ্ঠুর হওয়ার মতো ঝুঁকি নিয়েছেন এবং যেখানে তার আশেপাশের কেউ তাকে আরো ভুল করার ক্ষেত্রে বাধা দিতে সাহস পায়নি।
তথ্যসূত্র : বিবিসি