সহিংস সংঘর্ষের জেরে আরও একবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মণিপুরের পরিস্থিতি। গত কয়েকদিনে দফায় দফায় গুলি বিনিময়, বোমা বিস্ফোরণ, ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু, মণিপুর রাইফেলসের দুটি ব্যাটেলিয়নের অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্রশস্ত্র লুটের চেষ্টাসহ একাধিক ঘটনায় উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অবস্থা সামাল দিতে মোতায়েন করা হয়েছে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও যৌথ বাহিনী।
এদিকে, শান্তি ফেরানোর ক্ষেত্রে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রতিবাদে নেমেছেন বহু মানুষ। রোববার (৮ সেপ্টেম্বর) রাতে বিপুল সংখ্যক নারী ইম্ফলে রাস্তায় নামেন। রাজ্যে শান্তি ফেরানোর পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়ের পদত্যাগের দাবি তুলেছেন তারা।
এই আবহে রাজ্যপালের সঙ্গে বৈঠক করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, মণিপুরের পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য প্রশাসন সচেষ্ট। সাম্প্রতিক সহিংস সংঘর্ষে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের পাশে রয়েছে তার রাজ্যের বিজেপি সরকার। নিহত এক ব্যক্তির পরিবারের হাতে ক্ষতিপূরণের টাকাও তুলে দেন তিনি।
মণিপুর পুলিশের কর্মকর্তা কে খাবিব (আইজিপি, ইন্টেলিজেন্স) বলেন, রাজ্যে সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনাগুলোর কারণে, মণিপুর পুলিশ যৌথ বাহিনীর সঙ্গে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জেলা সদরে রয়েছেন ও পরিস্থিতি তদারকি করছেন।
ড্রোনের সাহায্যে হামলা চালানো হয়েছিল বলে জানা গেছে। পুলিশের সন্দেহ, হামলাকারী সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি সম্প্রদায়ভুক্ত। তারপর থেকে রাজ্যের একাধিক জায়গায় হামলা হয়েছে এবং কুকি ও মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। পুলিশের সঙ্গেও কুকি সম্প্রদায়ের সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যদের সংঘর্ষ হয়েছে।
দিল্লির মেইতেই আহ্বায়ক কমিটির সেরাম রোজেশ বিবিসি বাংলাকে বলেন, মণিপুরের বর্তমান পরিস্থিতি কিন্তু খুবই উদ্বেগজনক। আমরা অনুরোধ জানাচ্ছি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে হস্তক্ষেপ করার জন্য। মেইতেই গোষ্ঠীর মানুষের উপর নির্মম অত্যাচার চলছে।
সাম্প্রতিক সময়ে আক্রমণের জন্য যে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটা কারা জোগান দিচ্ছে সে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
কুকি সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষা কর্মরত সংগঠনের পক্ষ থেকে হাতজালহই হাওকিপ বলেন, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে মণিপুরে কুকি গোষ্ঠীর মানুষের উপর যে অত্যাচার চলছে, সে বিষয়ে রাষ্ট্র নীরব। আমরা কেন্দ্রীয় সরকারকে আমাদের পরিস্থিতির কথা জানিয়েছি। কিন্তু কিছুই হয়নি। এই মুহূর্তে মণিপুরে যা হচ্ছে, তা খুবই চিন্তার।
এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ভুয়া পোস্ট ঘিরে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ।
পুলিশ কর্মকর্তা খাবিব বলেন, আমি জনসাধারণকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা সবকিছু বিশ্বাস না করার অনুরোধ করবো। গুজবে কান দেবেন না। যদি কিছু চোখে পড়ে ও সে সম্পর্কে কিছু জানতে চান, তাহলে আমাদের কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করুন বা সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং সেলে যোগাযোগ করুন।
এদিকে, সোমবার সকাল থেকেই অবস্থান বিক্ষোভে শামিল হয়েছেন স্কুল ও কলেজের ছাত্ররা। মণিপুরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করছেন ইম্ফলের পড়ুয়ারা।
ড্রোন ও অত্যাধুনিক অস্ত্রের ব্যবহার
ড্রোন হামলা রুখতে অ্যান্টি ড্রোন সিস্টেম ব্যবহার করা হচ্ছে বলে পুলিশের তরফে জানানো হয়েছে। আইজিপি (ইন্টেলিজেন্স) কে খাবিব সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, সাম্প্রতিক হামলায় ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে। এই হামলা রুখতে অ্যান্টি ড্রোন সিস্টেম ব্যবহার করছে পুলিশ। পরিস্থিতির কথা ভেবে রাজ্য পুলিশ আরও অ্যান্টি ড্রোন সিস্টেম এবং অ্যান্টি ড্রোন গান কেনার কথাও ভাবছে।
এদিকে, কুকিদের পক্ষ থেকে অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের কথা অস্বীকার করা হয়েছে। হাতজালহই হাওকিপ বলেন, কুকিদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ ভিত্তিহীন। এত টাকা কোথায় যে অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করবে? তাদের বিরুদ্ধে এই জাতীয় অভিযোগ তুলছে কিন্তু এই সম্প্রদায়ের এত মানুষ যে প্রাণ হারালেন সে বিষয়ে তো কেউ কিছু বলছে না!
ওই সম্প্রদায়ের এক সদস্য প্রিম ভাইপেই যিনি আসাম ছেড়ে অন্য জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, দরিদ্র কুকিদের কাছে এত আধুনিক অস্ত্র কোথা থেকে আসবে? যদি আমাদের কাছে অস্ত্রই থাকত তাহলে আমরা আমাদের ভিটে-মাটি ছেড়ে উদ্বাস্তুর মতো থাকতে বাধ্য হতাম? গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে আমার ভিটে-মাটি ছাড়তে বাধ্য হই।