‘ব্রেন ডেথ’ কী? কেন হৃৎস্পন্দন চললেও এটি বলা হয়

লাইফস্টাইল ডেস্ক
  ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩:৩৭

আইসিইউর কাচঘেরা কক্ষের ভেতরে শুয়ে থাকা মানুষটিকে দেখলে মনে হয়, তিনি এখনও জীবিত। শরীরের উষ্ণতা আছে, বুক ওঠানামা করছে, মনিটরে স্পষ্ট হৃদস্পন্দনের রেখা। কিন্তু চিকিৎসকের ভাষায় তিনি আর জীবিত নন—এই অবস্থার নাম ‘ব্রেন ডেথ’। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই বাস্তবতা পরিবারের সদস্যদের জন্য সবচেয়ে বিভ্রান্তিকর ও মানসিকভাবে ভেঙে দেওয়ার মতো এক অভিজ্ঞতা।
ব্রেন ডেথ এমন একটি অবস্থা, যেখানে মানুষের মস্তিষ্ক ও ব্রেনস্টেম স্থায়ীভাবে সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে যায়। কৃত্রিম যন্ত্রের সাহায্যে তখনও শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃদযন্ত্র সচল রাখা সম্ভব হলেও, মস্তিষ্ক আর শরীরকে কোনও নির্দেশ দিতে পারে না। ফলে বাইরে থেকে জীবনের লক্ষণ দেখা গেলেও চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে তিনি মৃত।

কেন ঘটে ব্রেন ডেথ
মস্তিষ্কের কোষ একবার স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়ে গেলে সেগুলোর আর পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। গুরুতর ক্ষতির ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক আর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারে না। সাধারণত যেসব কারণে ব্রেন ডেথ ঘটে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে—

> স্ট্রোক
> হার্ট অ্যাটাক
> গুরুতর মাথায় আঘাত
> দীর্ঘ সময় অক্সিজেনের অভাব
> মস্তিষ্কের টিউমার
> এনসেফালাইটিসসহ বিভিন্ন সংক্রমণ

কীভাবে ব্রেন ডেথ ঘোষণা করা হয়
ব্রেন ডেথ ঘোষণা একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল ও জটিল প্রক্রিয়া। সাধারণত নিউরোলজিস্ট নির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক গাইডলাইন অনুসরণ করে ধাপে ধাপে পরীক্ষা করেন। সব পরীক্ষার ফল লিখিতভাবে নথিভুক্ত করা হয়। আইন অনুযায়ী, একবার ব্রেন ডেথ নিশ্চিত হলে সেই দিনটিকেই মৃত্যুর তারিখ হিসেবে গণ্য করা হয়, যদিও পরে হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়।

ব্রেন ডেথ ঘোষণার আগে চিকিৎসকেরা মূলত তিনটি বিষয় নিশ্চিত করেন—

১. চেতনার সম্পূর্ণ অনুপস্থিতিঃ আলো, শব্দ বা স্পর্শে কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় না।
২. সব রিফ্লেক্স বন্ধ থাকাঃ চোখে আলো ফেললে পিউপিল নড়াচড়া করে না, গ্যাগ রিফ্লেক্সসহ ব্রেনস্টেমের সব প্রতিক্রিয়া অনুপস্থিত থাকে।
৩. স্বাভাবিক শ্বাস নেওয়ার অক্ষমতাঃ ভেন্টিলেটর ছাড়া নিজে থেকে শ্বাস নেওয়ার কোনও চেষ্টা দেখা যায় না।

কোমা ও ব্রেন ডেথের পার্থক্য
অনেকের ধারণা, কোমা আর ব্রেন ডেথ একই বিষয়। কিন্তু বাস্তবে দুটো সম্পূর্ণ আলাদা। কোমায় থাকা রোগীর মস্তিষ্কে কিছু কার্যক্রম থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রে তারা ধীরে ধীরে জ্ঞানেও ফিরতে পারেন। অন্যদিকে ব্রেন ডেথ মানে মস্তিষ্কের সব কার্যক্রম চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়া।

যেসব পরীক্ষা করা হয়
ভুলভাবে ব্রেন ডেথ নির্ণয় এড়াতে প্রথমে নিশ্চিত করা হয় যে কোনও ওষুধের প্রভাব, শরীর অতিরিক্ত ঠান্ডা হয়ে যাওয়া বা রক্তচাপের সমস্যা নেই। এরপর করা হয়—

  • শারীরিক পরীক্ষা: চোখে তুলা স্পর্শ করা, আলো ফেলা, গলার রিফ্লেক্স পরীক্ষা
  • কোল্ড ক্যালোরিক টেস্ট: কানে ঠান্ডা পানি দিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখা
  • অ্যাপনিয়া টেস্ট: ভেন্টিলেটর খুলে স্বাভাবিক শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা পর্যবেক্ষণ
  • প্রয়োজনে ইইজি বা ব্রেন ব্লাড ফ্লো পরীক্ষা

ব্রেন ডেথ এমন এক কঠিন বাস্তবতা, যা মানসিকভাবে মেনে নেওয়া অত্যন্ত কষ্টকর। যন্ত্রের সাহায্যে হৃদস্পন্দন ও শ্বাস চলতে থাকলেও চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এটি মস্তিষ্কের মৃত্যু। কোনও পরিবারের জন্যই এই সত্য মেনে নেওয়া সহজ নয়।

সূত্র: ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক ও ভেরি ওয়েল হেলথ